প্রায়শই মাংস রান্না করতে গেলে দেখা যায় মাংস কেমন শক্ত হয়ে গেছে, সহজে কাটা যাচ্ছে না বা সেদ্ধ করা যাচ্ছে না৷ বিশেষ করে খাসির মাংস বা মাটন। তখন রান্না করতে বেশ বেগ পেতে হয়। এর কারণ হতে পারে সংরক্ষণের ত্রুটি। ফ্রিজে রাখা খাসির মাংস শক্ত হয়ে গেলে নরম করার উপায় কিছু আছে। কিন্তু যদি ঠিকঠাক মতো সংরক্ষণ করা যায় তাহলে এমন ঝামেলা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। আজকের আলোচনায় থাকছে শক্ত মাংস নরম করার টিপস। তবে তার আগে জেনে নিন কিভাবে মাংস সংরক্ষণ করলে সবসময় ফ্রেশ ও নরম থাকবে।
ক. ফ্রিজে রাখা খাসির মাংস কিভাবে সংরক্ষণ করলে শক্ত হবে নাঃ
১. কাটার পরে সাথে সাথে রাখবেন নাঃ
মাংস খুব বেশি শক্ত হয়ে যায় যদি কাটার পরে সাথে সাথে ফ্রিজে ঢোকানো হয়৷ পশু জবাইয়ের পর ৩-৪ ঘন্টা মাংস শক্ত থাকে। এই অবস্থায় ফ্রিজে রাখলে একেবারে পাথর হয়ে যাবে। আবার জবাইয়ের পর বেশিক্ষণ বাইরে ফেলে রাখলে মাংস অনেক নরম হয়ে যায়। এই মাংস পরে ফ্রিজে রাখলেও লাভ হয় না, পঁচা গন্ধ বের হয়। তাই ফ্রিজে মাংস রাখার সঠিক সময় হচ্ছে পশু জবাইয়ের অন্তত ৩ ঘন্টা পরে। ততক্ষণে মাংস কিছুটা নরম হয় এবং ফ্রিজে রাখার উপযোগী হয়।
২. খালি বা খোলা রাখবেন নাঃ
- কেউ কেউ খাসির মাংস ঢাকনা ছাড়া বাটিতে রেখে ফ্রিজে রেখে দেন। অথবা সরাসরি ফ্রিজের ড্রয়ারে মাংস রেখে দেন। এই কাজগুলো মাংস শক্ত ও দুর্গন্ধময় করে ফেলে। ডিপ ফ্রিজের ঠান্ডা আবহাওয়ায় কোন জলীয় বাস্প থাকে না। এই ঠান্ডা হাওয়া মাছ-মাংসের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে ন্যাচারাল ময়েশ্চার শুকিয়ে ফেলে।
- ময়েশ্চার শুকিয়ে গেলে মাছ-মাংস বেশ শক্ত হয়ে যায়। খোলা অবস্থায় রাখা মাংস ৩৬ ঘন্টার মধ্যে না খেলে নষ্ট হয়ে যায়৷ তাই মাংস এমনভাবে সংরক্ষণ করুন যাতে ঠান্ডা হাওয়া সরাসরি গিয়ে মাংসে না লাগে।
- ভালো মানের মোটা পলিথিনের ব্যাগ, ভ্যাকুয়াম-সিলড প্যাকেট, জিপ-লক প্লাস্টিক ব্যাগ, বা এয়ার-টাইট প্লাস্টিক বাটিতে মাংস রাখলে ভালো হয়৷ সবচেয়ে ভালো হয় যদি দোকান থেকে প্যাকেট করা মাংস এনে প্যাকেটসহই সরাসরি ফ্রিজে রেখে দেন।
৩. ঠেসে রাখবেন নাঃ
ফ্রিজে কখনোই মাংস ঠেসে রাখবেন না। চাপের মধ্যে থাকলে শক্ত হয়ে যাবে। আবার মাংস বড় খন্ডাকারে রাখলেও শক্ত হয়ে যায়। তাই রাখার সময়ে মাংস ছোট ছোট টুকরা করে কেটে ব্যাগে বা বাটিতে রাখবেন। প্লাস্টিকের ব্যাগে মাংস রাখলে মধ্যে হালকা ফাঁকা রেখে পাশাপাশি কয়েকটা ব্যাগ রাখবেন।
একটার উপর আরেকটা ব্যাগ রাখতে হলে মাঝে পলিথিন বা মোটা কাগজ দিয়ে দেবেন। আর সবসময় আধা কিলো বা এক কিলো পরিমাণে সংরক্ষণ করবেন। এতে মাংসের কনসিসটেন্সি ঠিক থাকবে আবার যেকোন সময় রান্না করতেও সুবিধা হবে।
৪. বেশিদিন ফ্রিজে রাখবেন নাঃ
- আগেই বলেছি ডিপ ফ্রিজের হিম খাবারের ন্যাচারাল ময়েশ্চার শুকিয়ে খাবার শক্ত করে ফেলে। এখন ভেবে দেখুন এই হিমের মধ্যে যদি মাংস বেশিদিন ফেলে রাখেন তাহলে কি অবস্থাটা হবে। তাই কাঠিন্য রোধ করতে মাংস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।
- সাধারণ নিয়মে ৩-৫ দিনের বেশি মাংস সংরক্ষণ করা উচিত না। ঠান্ডায় যত কম থাকবে তত মাংসের পুষ্টিগুণ এবং কনসিসটেন্সি ঠিক থাকবে৷ তবে কয়েক মাস মাংস ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করতে চাইলে ফ্রিজের তাপমাত্রা ০° ডিগ্রী ফারেনহাইটে সেট করতে হবে।
খ. ফ্রিজে রাখা খাসির মাংস শক্ত হয়ে গেলে নরম করার উপায়ঃ
১. থয়িংঃ
- ইংরেজিতে শক্ত মাংস নরম করার প্রক্রিয়াকে ‘থয়িং’ বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাংস নরম করতে হয় মৃদুভাবে। বহুদিনের সংরক্ষিত মাংস যত মৃদুভাবে নরম করবেন তত মাংসের কোয়ালিটি ঠিক থাকবে।
- রান্নার অন্তত একদিন আগে মাংস ডিপ ফ্রিজ থেকে নামিয়ে নর্মাল ফ্রিজে রাখবেন। এতে ঠান্ডা ও শক্ত ভাবটা কিছুটা কমে যাবে। তবে এই নিয়ম শুধুমাত্র তাজা মাংসের জন্য। ফ্রোজেন মাংস, পশুর কাঁধের মাংস, বা চর্বিযুক্ত মাংস নরম হতে বেশ সময় লাগে। সেক্ষেত্রে এগুলো কমপক্ষে তিন-চারদিন নর্মাল ফ্রিজে রাখতে হতে পারে।
- ঠান্ডা জল দিয়ে ‘থ’ করতে পারবেন। মাংস নামিয়ে ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে রাখলেই যথেষ্ট৷ ৫০০ গ্রাম পরিমাণ মাংস জলে নরম করতে বড়জোর এক ঘন্টা সময় লাগবে। এর চেয়ে বেশি পরিমাণের মাংস ভিজতে দুই ঘন্টা বা তারও বেশি লাগতে পারে। তবে জল দিয়ে নরম করার ক্ষেত্রে একবারে ২ কিলোর বেশি মাংস না ভেজানোই ভালো।
- গরম জল বা মাইক্রোওয়েভ দিয়ে থয়িং একদমই করা যাবে না। এগুলোতে হয়তো সময় কম লাগতে পারে, কিন্তু তাপমাত্রার আকস্মিক অস্বাভাবিকতা মাংসের কোয়ালিটি নষ্ট করে ফেলবে।
২. লবণঃ
স্টেক রান্নার এক ঘন্টা আগে এতে সি সল্ট মাখিয়ে রাখবেন। সাধারণ লবণ বা টেবিল সল্ট দেওয়া যাবে না। সি সল্ট মাংসের ভেতর ঢুকে শক্ত হয়ে যাওয়া প্রোটিন গলিয়ে ফেলবে এবং স্টেকের টেক্সচার স্বাভাবিক করবে।
৩. চা এবং রেড ওয়াইনঃ
এগুলোতে ট্যানিন থাকে, যা ন্যাচারাল মিট টেন্ডারাইজার হিসেবে পরিচিত। যদি চা ব্যবহার করতে চান, তাহলে মাংসের পরিমাণ বুঝে এক কাপ বা দুই কাপ কড়া লিকারের ব্ল্যাক টি বানিয়ে নিন। ঠান্ডা করে তা দিয়ে স্টেক মেরিনেট করে রাখুন কিছুক্ষণ, নরম হয়ে যাবে। রেড ওয়াইন অ্যাভেইলেবল থাকলে সেটা দিয়েও মেরিনেট করতে পারেন।
৪. অ্যাসিডিক উপাদানঃ
অ্যাসিডিক উপাদান মাংসের মাসল ফাইবার নরম করে এবং স্বাদ বাড়ায়। লেবুর রস বা আনারসের পিউরি দিয়ে স্টেক মেরিনেট করতে পারেন। ভিনেগার ব্যবহার করলে অ্যাপেল সিডার, বালসামিক, বা সাধারণ ভিনেগার ব্যবহার করবেন। টমেটো ব্যবহার করতে পারেন বারবিকিউ সস হিসেবে। কোলা বা বাদামি কার্বোনেটেড ড্রিংকও কিন্তু অ্যাসিডিক উপাদান। এটা দিয়ে স্টেক সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত মেরিনেট করে রাখা যাবে।
৫. আদাঃ
আদার প্রোটিওলাইটিক এনজাইম শক্ত প্রোটিন দ্রবীভূত করে। এটাও খাসির শক্ত মাংস নরম করতে সাহায্য করে।
৬. বিয়ারঃ
স্টেক গ্রিল বা ফ্রাই করার অন্তত ঘন্টাখানেক আগে বিয়ার দিয়ে মেরিনেট করে রাখবেন। এতে বিদ্যমান আলফা অ্যাসিড এবং ট্যানিন খাসির মাংস নরম করতে সাহায্য করে।
৭. কফিঃ
কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে তা ঠান্ডা করে নিন। এটা দিয়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত খাসির মাংস মাখিয়ে রাখতে পারবেন। যার ফলে মাংস নরম হয়ে যাবে।
৮. দুগ্ধজাত পণ্যঃ
বাটারমিল্ক এবং টকদইতে আছে অ্যাসিডিক এবং ক্যালসিয়াম কন্টেন্ট৷ এই দুটি দুগ্ধজাত পণ্য মাংসের অভ্যন্তরীণ এনজাইমকে সক্রিয় করে তোলে৷ ফলে প্রোটিন ভেঙে মাংস সফট হয়।
৯. ফিগ, আনারস, কিউয়ি, পেঁপেঃ
এগুলোতে ভেজিটেবল এনজাইম থাকে যা প্রোটিন এবং কানেক্টিভ টিস্যুগুলোকে গলিয়ে ফেলে। যেকোন একটি খাবার ম্যাশ করে বা স্লাইস করে কেটে নিন। এবারে এটা থিন কাট মিটের উপর কয়েক ঘন্টা রেখে দিন।
১০. মিট হ্যামারঃ
বাজারে মাংস নরম করার জন্য এক ধরণের মিট হ্যামার পাওয়া যায়। এটা দিয়ে আলতো করে আঘাত করে মাংস সফট করা যায়৷ রুম টেম্পারেচারে মাংস কিছুক্ষণ রাখার পরে একটা টুকরা মিট হ্যামার দিয়ে পিটিয়ে নিবেন। তবে বেশি জোরে আঘাত করবেন না, এতে মাংস থেঁতলে যেতে পারে।