ধোঁয়া ওঠা গরম এক প্লেট ভাত ছাড়া ভেতো বাঙালির দিন কল্পনা করা যায় না৷ বাঙালির চিরচেনা খাদ্যাভ্যাসে আর কিছু না থাক মাছ আর ভাত থাকবে ঠিকই। তবে আধুনিক যুগে স্বাদের চেয়ে শরীর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পেট ভরে ভাত খাওয়ার চিন্তা অনেকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছেন শরীরে মেদ জমে যাওয়ার ভয়ে।
কিন্তু সত্যি কথা হলো, শুধু ভাত ওজন বাড়ানোর জন্য দায়ী না, বরং এটি ওজন বাড়ার একটি কারণ হতে পারে। মোটা হয়ে যাবার ভয়ে পুষ্টির এই মূল উৎসকে একেবারে বাদ দেয়া চলবে না। ভাত খেলেও বাড়বে না মেদ, তবে কিভাবে আর কতটুকু খাবেন জানেন কি সেটা? উত্তর যদি না হয় তাহলে আজকের লেখা পড়ে ফেলুন ঝটপট।
ভাত কিভাবে খেলে মেদ বাড়বে না?
ভাত খেলেই ওজন বাড়ে – এমন ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য খাদ্য বিশেষজ্ঞরা ভাত খাওয়ার কিছু নিয়ম বের করেছেন। এই নিয়মগুলো মেনে চললে মেদ তো বাড়বেই না বরং সকাল-বিকাল ভাত খেলেও শরীর থাকবে সুস্থ। এখন জানতে পারবেন ভাত খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে।
আনপলিশড চালের ভাতঃ
পলিশড চাল মেশিনের চাপের কারণে পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ঢেঁকিছাটা বা আনপলিশড চাল পুষ্টিতে ভরপুর থাকে এবং শর্করার পরিমাণ কম থাকে। ঢেঁকিছাটা চালে রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন, নিয়াসিন, পাইরিডক্সিন, এবং ফলিক অ্যাসিড তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। ব্ল্যাক রাইস ও ব্রাউন রাইসের চালের আবরণীতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। সাদা, পলিশড চালের বদলে এই চালগুলো খেলে সারাদিনের হোল গ্রেইনের চাহিদা দুই-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়ে যায়।
তরকারি দিয়ে ভাত খানঃ
আমরা সবসময় ভাত দিয়ে তরকারি খাই, অর্থাৎ ভাত বেশি খাই তরকারি একটু কম খাই। যদি ওজন বাড়াতে না চান, তাহলে তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন। অর্থাৎ খাবার পাতে তরকারি থাকবে মেইন খাবার ভাত থাকবে সেকেন্ডারি খাবার। প্রথমে পাতে তরকারি নিবেন তারপরে ভাত, দুটোর পরিমাণ থাকবে একদম সমান সমান।
তরকারি বেশি করে খেলে আরো ভালো হয়, তাতে ভাতের চাহিদা কমবে। আর বারবার ভাত নেয়ার ইচ্ছাও হবে না। তরকারি বেঁচে গেলেও ভাত পুনরায় নিবেন না। তবে তরকারি খাওয়ার সময়ে দেখবেন তাতে যেন আলু না থাকে। আলু ও ভার্তের শর্করা একযোগে ওজন বাড়িয়ে দিবে। আলু ভর্তাও খাওয়া নিষিদ্ধ যদি ভাত খেয়ে স্লিম থাকতে চান।
ডাল, মাছ, বা মাংস দিয়ে ভাত খাবেন, সাথে লেবু থাকবে। এই আইটেমগুলো আপনি যাতে বেশি ভাত খাওয়ার ইচ্ছা কমিয়ে ফেলবে। ব্রোকলি বা বিনসের তরকারি দিয়ে ভাত খেলেও উপকার পাবেন।
কাঁচা সবজির সালাদ খানঃ
ভাতের সাথে আর কিছু খান বা না খান কাঁচা সবজির অবশ্যই সালাদ খাবেন। শসা, টমেটো, গাজর, বাঁধাকপি দিয়ে সালাদ বানাবেন, সামান্য পরিমাণ লবণ ছাড়া আর কোনরকমের ড্রেসিং থাকবে না সালাদে। এক কাপ ভাতের সাথে খেতে হবে এক কাপ সালাদ। ড্রেসিং ছাড়া সালাদের পাশাপাশি শাকও খাবেন বেশি করে। এভাবে খেলে আপনার ডায়েট চার্ট ব্যালেন্সড থাকবে।
অল্প পরিমাণে ভাত খাবেনঃ
প্রতিদিন দুই বেলা অল্প পরিমাণে ভাত খাবেন। তিন বেলা খেলে ওজন বাড়ার ঝুঁকি থেকে যাবে। এক কাপ বা আধা কাপের বেশি কখনোই খাবেন না। প্লেটভর্তি ভাতের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমিয়ে আনুন। একটা সময়ে নিজেরই ইচ্ছা করবে না বেশি বা বারবার ভাত খাওয়ার। সারাদিনে ১৫০ গ্রাম চালের বেশি ভাত খাওয়া উচিত না। এই পরিমাণ চাল গ্রহণে ৫০০ ক্যালরি পাওয়া যাবে।
বদঅভ্যাস ছাড়ুনঃ
নিয়ম মেনে ভাত খাওয়ার পরেও কিছু উল্টাপাল্টা অভ্যাসের কারণে ওজন ও রোগ দুটোই বেড়ে যাবে শরীরে। তাই এই অভ্যাসগুলো যত দ্রুত পারবেন ছাড়বেন –
- দুপুরে ভাত খেয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়া উচিত না। নাহলে হজমক্রিয়া ধীর হয়ে শরীরে মেদ জমে যাবে। তাই ভাতঘুম দেয়ার আগে কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা হাঁটাচলা বা কাজ করা উচিত।
- ভাত খেয়েই সাথে সাথে কোন ড্রিংকস গ্রহণ করা উচিত না। ভাতের পরপরই চা, কফি, কোমল পানীয়, বা ভাজাপোড়া খেলে স্টার্চ গলে নিঃশেষ হতে পারে না, শরীরে থেকে যায়। তবে ভাতঘুম ঠেকাতে চাইলে খাওয়ার পরপরই ব্ল্যাক কফি বা গ্রিন টি খাওয়া যেতে পারে। তবে পরামর্শ রইলো, কফি বা গ্রিন টি খেতে চাইলেও ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে খাওয়া উচিত।
- ভাত খাওয়ার পরপরই স্নান করা ওজন বাড়ার আরেকটি কারণ। এতে মেটাবলিজমের হার কমে হজম ক্রিয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর ওজন বাড়তে থাকে তরতরিয়ে। তাই খাওয়ার পড়ে স্নান করলে অন্তত ১ ঘন্টা পরে স্নান করা উচিত। সবচেয়ে ভালো আগে স্নান করা।
কিভাবে ভাত রান্না করলে ওজন বাড়বে না?
অনেকসময় ভুল পদ্ধতিতে ভাত রান্না করে খেলে শরীর মুটিয়ে যায়। সঠিক পরিমাণে ভাত খাওয়া যেমন আবশ্যক, তেমনি সঠিক পদ্ধতিতেও ভাত রান্না করার অত্যাবশ্যক। নয়তো ভাতের পুষ্টি বৃথা যায়। এখন জানবেন কিভাবে ভাত রান্না করলে ওজন বাড়বে না সে সম্পর্কে।
চাল কম ধোবেনঃ
চালের ময়লা ঝরানোর জন্য আমরা চাল একটু বেশি ধুয়ে থাকি৷ এতে চাল পরিষ্কার হয় ঠিকই, কিন্তু চালের ভিটামিন ও মিনারেল জলের সাথে চলে যায়। তাই ভাতের চাল বেশি ধোয়ার দরকার নেই। সর্বোচ্চ দুইবার ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিলেই যথেষ্ট৷
সঠিক কুকার বেছে নিনঃ
রাইস কুকারে ভাত রান্না করা একদমই উচিত না। সাধারণভাবে ভাত রান্না করলে যতোটুকু পুষ্টিগুণ থাকে, রাইস কুকারে রান্না করলে সেই পুষ্টিটা নষ্ট হয়ে যায়। রাইস কুকারের ভাত খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। তাই পাতিলে স্টিমে ভাত রান্না করুন। চাইলে প্রেশার কুকারেও ভাত রান্না করতে পারেন, এটি রাইস কুকারের মতো ক্ষতিকর না।
মাড় ফেলবেন না
ভাতের মাড়ে ভাতের ভিটামিন ও মিনারেল অনেকটাই থাকে। রান্নার পরে মাড় ঝরিয়ে ফেলে দিলে পুষ্টিগুণ চলে যায়। তাই মাড় যাতে ফেলতে না হয় সেভাবে রান্না করুন। রান্নার সময় জল কম দিলে মাড় ফেলতে হবে না। চাইলে ফুটন্ত গরম জলে চাল ঢেলে রান্না করা যাবে৷
ভাপে রান্না করুনঃ
চাল রান্না করতে হয় ভাপে। স্টিম-কুকিংয়ে ভাতের স্টার্চ ধীরে ধীরে রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চে পরিণত হয়। ফলে ভাপে রান্না করা ভাত অল্প খেলেই সারাদিন পেট ভরা থাকে। তাই চাল যখন ফুটে নরম হয়ে যাবে তখন চুলা বন্ধ করে ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ি ঢেকে রাখুন। ভাত এবার স্টিমে থাকবে এবং আস্তে আস্তে ঠান্ডা হবে। চাল দিয়ে অন্য কোন আইটেম রান্না করার সময়ে চাল আগে সিদ্ধ করে নিবেন, ভাজবেন না।
ভাত রান্নার বিশেষ রেসিপিঃ
ভাতের স্টার্চ সহজে হজম না হলে সেটাই পরবর্তীতে শরীরে জমে মেদ বাড়িয়ে দেয়। তাই ভাত রান্না করার সময়ে নারিকেল তেল ব্যবহার করুন। চালের জল যখন ফুটে উঠবে তখন এতে নারিকেল তেল দিয়ে দিন। আধা কাপ ভাতের জন্য ১ চা চামচ তেল নিতে হবে। ভাতের পরিমাণ বাড়লে তেলের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এই পদ্ধতিতে রান্না করলে ভাতের ক্যালরি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।