একসময় পান্তা ভাত ছিলো নিম্নবিত্তদের খাবার। আগের দিনের বেঁচে যাওয়া ভাত জলে ভিজিয়ে পরেরদিন সকালের খাবার হিসেবে খাওয়া হয়। কিন্তু আধুনিক মেডিকেল সাইন্সের গবেষণায় উঠে এসেছে পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ এবং নানা ধরণের উপকারিতা। ফলে এখন সেটা উচ্চবিত্তদের খাবার টেবিলে ঠাঁই পেয়েছে।
অনেকে মনে করেন ভাতে জল দিয়ে রাখলেই বা ভিজিয়ে ফ্রিজে রেখে দিলেই পান্তা ভাত হয়ে যায়। কিন্তু পান্তা বানানোর নিয়ম আছে। আজকের আর্টিকেলে থাকছে পান্তা ভাত খেলে কি কি উপকার পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।
ক. পান্তা ভাতের কি কোনো উপকারিতা আছে?
অবশ্যই আছে, সাধারণ ভাতের চাইতে পান্তা ভাতের উপকারিতা ঢের বেশী। ভাতে জল দিয়ে সাধারণ রুম টেম্পারেচারে কমপক্ষে ১২ ঘন্টা রেখে দিলে ফারমেন্টেশন হয় এবং পান্তা তৈরি হয়।
এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ গ্রাম ভাতে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যথাক্রমে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম এবং ৮৫০ মিলিগ্রাম। যা গরম ভাতে থাকে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম এবং ২১ মিলিগ্রাম। এছাড়াও পটাশিয়াম বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩৯ মিলিগ্রামে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ১০০ গ্রাম গরম ভাতে সোডিয়াম থাকে ৪৭৫ মিলিগ্রাম, কিন্তু সমপরিমাণ পান্তা ভাতে তা কমে দাঁড়ায় ৩০৩ মিলিগ্রামে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ভিটামিন বি এবং শর্করা সমৃদ্ধ জলীয় খাবার পান্তা ভাত গরমের দিনে শরীর ঠান্ডা, ভারসাম্যপূর্ণ, তরতাজা, এবং কর্মক্ষম রাখে।
এখন জেনে নিন পান্তা ভাতের উপকারিতা সম্পর্কেঃ
১. বুকের দুধের উৎপাদন বাড়েঃ
পান্তা ভাতের সবচাইতে বড় উপকারিতা হলো, এটা দুধ পান করা শিশুর মায়ের জন্য বেশ উপকারী। কারণ পান্তা ভাত বুকের দুধের উৎপাদন বাড়ায়। পান্তা ভাতে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া বুকের দুধ বৃদ্ধি করে। আর পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেলে শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, যা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
২. জলশূন্যতা দূর হয়ঃ
সারারাত ভিজিয়ে রাখার ফলে ভাতের দানায় জল সংরক্ষিত হয়। তাই এক থালা পান্তা ভাত খেলে শরীরে জলের অভাব দূর হবে নিশ্চিত। তাই জলশূন্যতা জনিত জটিলতায় আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকিও কমে যায়। প্রচন্ড গরমে হিটস্ট্রোক হয় অনেকেরই। তখন শরবত বা জল খেলে যতোটা উপকার হয়, পান্তা ভাত খেলেও তার সমান উপকার পাওয়া যায়।
৩. রক্তস্বল্পতা দূর হয়ঃ
পান্তা ভাত আয়রনের একটা ভালো উৎস। গরম ভাতে যেটুকু আয়রন পাওয়া যায়, পান্তা ভাতে পাওয়া যায় তার কয়েক গুণ বেশী। শরীরে আয়রনের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা আমরা সবাই জানি। শুধু পান্তা থেকেই শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকটা পূরণ হয়ে যায়। পিরিয়ডের সময়ে মেয়েদের শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণ না হলে আরো সমস্যার সৃষ্টি হয়। আয়রন যেহেতু রক্ত তৈরি করে, তাই পিরিয়ডের সময়ে পান্তা ভাত খাওয়া উচিত। এছাড়াও রক্তস্বল্পতায় ভোগা রোগীদের জন্য পান্তা ভাত আদর্শ একটা পথ্য।
৪. রক্তে অক্সিজেন তৈরি হয়ঃ
পর্যাপ্ত আয়রন যেমন রক্তের ঘাটতি দূর করে, তেমনি দূর করে অক্সিজেনের স্বল্পতাও। আয়রন রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই পান্তা ভাত খেলে রক্তের সকল সমস্যা দূর হয়ে যায়।
৫. প্রদাহ কমেঃ
পান্তা ভাতে বিটা-সিটোস্টেরল এবং কেম্পেস্টেরোল নামক কিছু উপাদান বিদ্যমান থাকে। এই উপাদান শরীরের প্রদাহ বা যন্ত্রণা কমিয়ে দেয়। রোদের তাপে শরীরে কোথাও যন্ত্রণা হলে পান্তা ভাত তা থেকে প্রশান্তি দান করে।
৬. ক্যান্সারের ঝুঁকি কমেঃ
পান্তা ভাতে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান। এই উপাদান দেহে ক্যান্সারের কোষ তৈরি এবং বিস্তারে বাধা প্রদান করে। ফলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। তাছাড়াও পান্তা ভাতে উপস্থিত আরো বহু পুষ্টি উপাদান শরীর ঠান্ডা এবং যন্ত্রণামুক্ত রাখে বিধায় ক্যান্সার প্রতিরোধ অনেকাংশে হয়ে যায়।
৭. শরীর তরতাজা এবং কর্মক্ষম থাকেঃ
মানবদেহে উপস্থিত অম্ল ও ক্ষারের সমতা না থাকলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অত্যধিক তাপমাত্রা দেহের ক্ষতিসাধন করে। পান্তা ভাত এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এটি অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষার মাধ্যমে দেহ ঠান্ডা রাখে। সেই সাথে দেহে হালকা অনুভূত হয়, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৮. হাড় মজবুত হয়ঃ
গরম ভাতের চাইতে পান্তা ভাতে ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশী। এই দুইটি উপাদান হাড় গঠন ও মজবুত করতে সাহায্য করে। বাড়ন্ত শিশু এবং বয়স্ক মানুষের জন্য নিয়মিত পান্তা ভাত খাওয়া জরুরি। কারণ এই বয়সসীমায় হাড়ের জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
৯. পেট সুস্থ থাকেঃ
পান্তা ভাতের এমনই আশ্চর্য গুণ, যা পেটের সকল রোগবালাই দূরে রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সময়ে পান্তা ন্যাচারাল ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে। এতে পেট পরিষ্কার হয়। উপকারী ব্যাকটেরিয়ায় ভরপুর পান্তা ভাত হজমক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। তাই অ্যাসিডিটি হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। সকল ধরণের আলসার থেকে পান্তা ভাত মুক্তি দেয়। আবার ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট জলশূন্যতা রোধে পান্তা ভাত দারুণ কাজ করে।
১০. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকেঃ
গরম ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশী থাকে। তাই এটা রক্তচাপ বাড়াতে পারে। কিন্তু পান্তা ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক কম থাকে বিধায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পান্তা অনন্য ভূমিকা পালন করে। আবার এতে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশী থাকে, যা রক্তচাপ বাড়তে দেয় না। এই ভাতে উৎপাদিত রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। ফলে রক্তচাপ এবং হৃদপিন্ডের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকে।
১১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়েঃ
ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ বেড়ে যায়। ফলে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সাধারণ বা গরম ভাতও শরীরের জন্য উপকারী, তবে তাতে পুষ্টিগুণ অনেক কম থাকে।
১২. এনার্জি পাওয়া যায়ঃ
পান্তা ভাত একদিকে যেমন শরীর হালকা করে, আরেকদিকে পেট অনেকক্ষণ ভরা রাখে। আর পেট ভরা থাকলে কাজের জন্য যথেষ্ট এনার্জি পাওয়া যায়।
১৩. ওজন কমেঃ
সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে ফ্যাটের পরিমাণ অনেক কম। তাই এটা ওজন বাড়তে দেয় না বা বাড়তি ওজন ঝরাতে সাহায্য করে। ডায়েট কন্ট্রোলের জন্য পান্তা ভাত খাওয়া নিরাপদ। কিন্তু ওজন কমানোর জন্য পান্তা ভাত খেতে হলে অবশ্যই সীমিত পরিমাণে খেতে হবে।
১৪. ত্বক সুন্দর হয়ঃ
পান্তা ভাত কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। কোলাজেন ত্বকের ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ৷ নিয়মিত পান্তা ভাত খেলে ত্বক উজ্জ্বল, মসৃণ, এবং টানটান থাকে।
খ. পান্তা ভাতের কি কোনো অপকারিতা আছে?
হ্যাঁ আছে। ভাত যেহেতু শর্করা প্রধান খাদ্য, তা গরম হোক বা পান্তা, ডায়বেটিস রোগীদের জন্য কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। ডায়বেটিকদের তাই পান্তা ভাত সতর্কতার সাথে এবং পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। আবার অতিরিক্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় তা বয়স্কদের শরীরে রিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তা ভাত খানিকটা অ্যালকোহলিক হয়ে যায়। এটা খেলে শরীর ম্যাজম্যাজ করে এবং ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। ভাতে দেয়ার জলটা যদি বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবে এবং শরীরের ক্ষতি করবে।