সারাদিনের খাটাখাটুনির পরে ৬-৭ ঘন্টার নিবিড় একটি ঘুম মহা আকাঙ্ক্ষিত এক বস্তু। রাতের ঘুমটা যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে সারাদিন মনমেজাজ অত্যন্ত খারাপ থাকে, কাজে ব্যাঘাত ঘটে। দীর্ঘমেয়াদে ঘুমের অনিয়ম হলে শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধে। সঠিক সময়ে ঘুম না আসার পেছনে অনেক কারণ থাকে, তারমধ্যে একটি হচ্ছে খাবার। হ্যাঁ ঠিক পড়েছেন, খাবারের কারণে অনিদ্রা, ডায়বেটিস, স্থুলতা সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। আজকের লেখা থেকে ঘুম নষ্ট করে যেসব খাবার সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
১. গ্রিন টিঃ
শরীর স্লিম রাখতে গ্রিন টি দারুণ কার্যকরী। তবে এই জাদুকরী পানীয়টি কিন্তু আপনার রাতের ঘুমের বারোটা বাজাতে যথেষ্ট৷ গ্রিন টি তে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে যা মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে। ফলে সহজে ঘুম আসে না। আপনি রাতে ঘুমের আগে যদি গ্রিন টি খেয়ে থাকেন তাহলে ঘুমের কথা ভুলে যান।
২. কফিঃ
ক্লান্তি, স্ট্রেস দূর করে শরীরকে চনমনে রাখতে কফির জুড়ি নেই। হুটহাট মাথা ব্যথায় এক কাপ গরম কফি পানে আরাম মেলে। অসংখ্য উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও কফি ঘুম নষ্ট করার জন্য দায়ী। কফির অ্যাসিডিক উপাদান মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে এবং ঘুম উদ্রেককারী হরমোনকে আটকে দেয়। এর ক্যাফেইন শরীরে কয়েক ঘন্টা সচল থাকে, তাই ঘুমানোর ঠিক আগে কফি খেলে আর ঘুম আসে না। অতিরিক্ত কফি পান ঘুমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৩. কোমল পানীয়ঃ
কোমল পানীয়ের স্বভাব চরিত্র এর নামের ঠিক বিপরীত৷ কার্বোনেটেড ওয়াটার শরীরের জন্য অপকারী জেনেও অনেকে এটি পান করে থাকেন৷ বিশেষ করে ভারী ভোজের পরে কোমল পানীয় পানে খাবার দ্রুত হজম হয়। এই লিকুইড একদিকে সাময়িক উপকারিতা দেয়, অন্যদিকে ঘুমের সাইকেল নষ্ট করে। এটি ব্লাড সার্কুলেশনে বাধা প্রদান করে। আবার এতে থাকা গ্যাসীয় উপাদান এবং মাত্রাতিরিক্ত চিনি ঘুম উদ্রেককারী হরমোনকে বাধাগ্রস্ত করে।
৪. জলঃ
সাধারনত দৈনিক ৭-৮ গ্লাস জল পান শরীরের জন্য আদর্শ৷ এই পরিমাণ জলনি সারাদিন খেলে শরীর হাইড্রেটেড থাকবে। কিন্তু রাতে, বিশেষ করে ঘুমের আগে বেশি জল খেলে বারবার প্রস্রাব হবে। ২-৩ ঘন্টা পরপরই ঘুম ভেঙে বাথরুমে দৌড়াতে হবে।
৫. অ্যালকোহল ও ধূমপানঃ
অ্যালকোহল ও ধূমপান শরীরে দারুণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। নিয়মিত ঘুমের আগে অ্যালকোহল সেবন করলে সহজে ঘুম আসে না। আসলেও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মজার ব্যাপার হলো, অ্যালকোহল রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে মস্তিষ্কের নার্ভ শিথিল করে। এতে ঘোর ও নিদ্রাভাব তৈরি হয়, কিন্তু পরিপূর্ণ ঘুম হয় না। যদি ঘুম এসেও যায়, তবুও শরীর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে অ্যালকোহলকে তার সিস্টেম থেকে বের করার জন্য। ফলস্বরূপ, পরদিন ঘুম ভাঙে তীব্র পিপাসা, মাথাব্যথা, এবং মাথা ঘোরানো নিয়ে। ধূমপানও অ্যালকোহলের মতো মস্তিষ্ককে শিথিল করে। কিন্তু গভীর ঘুম হয় না, বরং ঘুমের নামে মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত অ্যাকটিভ রাখে।
৬. তেল, মশলা, ও ঝালজাতীয় খাবারঃ
এই ধরণের খাবার হজম হতে বেশ সময় নেয়। তাই শোয়ার আগে এই খাবার খেলে বদহজম ও গ্যাসের সমস্যা হবে। ফলে শান্তির ঘুম ব্যাহত হবে। যারা ঝাল খাবার খেতে খুব ভালোবাসেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ। ঘুমানোর আগে ঝাল খেলে গ্যাস্ট্রোএসোফেজিয়াল রিফ্লেক্স হয়। এতে পেটে ও বুকে জ্বালাপোড়া তো হয়ই, সাথে গলার স্বরেও প্রভাব পড়তে পারে। এতো সমস্যা যখন একসাথে তৈরি হয়, তখন আন্দাজ করে দেখুন আপনার রাতের ঘুম ঠিক কেমন হবে।
৭. ফাস্টফুডঃ
ফাস্টফুড সাময়িকভাবে ক্ষুধা মেটায়, পাশাপাশি ঘুমের সাইকেল নষ্ট করে। ফাস্টফুডের উচ্চমাত্রার অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট বুকে জ্বালাপোড়া এবং পেটে অ্যাসিড তৈরি করে। এসব খাবার সহজপাচ্য না তাই ঘুমের মধ্যে দেহের ওজন বেড়ে যায় এবং হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়। ফলে মারাত্মক শারীরিক অস্বস্তি হয় এবং ঘুম নষ্ট হয়।
৮. চকলেটঃ
চকলেটও কিন্তু ঘুম না আসার একটি কারণ, সেটা জানেন কি? ডার্ক চকলেটে ক্যাফেইন থাকে যা ঘুম দেরিতে আসার জন্য দায়ী। ঘুমের আগে চকলেট খেলে স্বভাবতই সময়মতো ঘুম হবে না।
৯. আইসক্রিমঃ
চকলেটের মতো আইসক্রিমও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার জন্য দায়ী। প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট আর চিনি থাকার কারণে আইসক্রিম সহজে হজম হয় না। এতে শরীরে মেদ জমে যায় তাড়াতাড়ি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেলে বদহজমের কারণে ঘুম পালাবে।
১০. মিষ্টি ও চিনিজাতীয় খাবারঃ
আপনি যদি রাতে খাওয়ার পরে মিষ্টি খান, তাহলে আপনার শরীরে শর্করার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। এরপরে শরীরে শিথিলতা আসবে, ওজন বাড়বে, এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। একই ঘটনা ঘটে চিনি ও চিনিজাতীয় খাবার বা প্রসেসড ফুডের ক্ষেত্রেও। প্রসেসড খাবারে যে ধরণের চিনি ব্যবহার করা হয় তা দ্রুত রক্তে মিশে যায়। এর ফলে শরীরে তৎক্ষণাৎ শক্তি তৈরি হয়। দ্রুত তৈরি হওয়া শক্তি দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। আর সুগার লেভেলের আকস্মিক পতনের কারণে আবার ক্ষুধা লাগে এবং ঘুম ভেঙে যায়। তাছাড়া প্যাকেটজাত খাবারের চিনি দাঁত ও মাড়ির ক্ষতি করে বলে দাঁতের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ঘুম হয় না।
১১. কর্নফ্লেক্সঃ
আপনি হয়তো খুব ক্লান্ত, রাতের খাবার বানানোর শক্তিটুকুও নেই আপনার। কোনমতে এক বাটি কর্নফ্লেক্স খেয়ে ঘুমানোর চিন্তাভাবনা করছেন। এতে কিন্তু নিজেই নিজের ঘুমের ক্ষতি করবেন। কর্নফ্লেক্সে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট থাকার কারণে তা ঘুম আসার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
১২. রেড মিটঃ
রেড মিট হজম হতে অনেক সময় নেয়। তার পাশাপাশি এটি শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শোয়ার আগে রেড মিট খেলে বদহজমে পেট ফুলে ও ফেঁপে যাবে। ফলে গাঢ় ঘুম তো দূরের কথা, দু’চোখের পাতা এক করাই মুশকিল হয়ে যাবে।
১৩. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারঃ
রেড মিটের মতো মাছ, ডাল ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ঘুমের আগে খেলে হজম দেরিতে হবে। শরীরে প্রচুর এনার্জি এবং উত্তেজনা তৈরি হবে। উত্তেজিত শরীরে ঘুম আসার কোন নামগন্ধও থাকবে না।
১৪. সবুজ শাকসবজিঃ
প্রচুর ফাইবারে সমৃদ্ধ সবুজ শাকসবজি খুব ধীরে ধীরে পরিপাক হয়। দিনের বেলা সবুজ শাকসবজি খেলে ফাইবার অনেকক্ষণ পেটে থাকে। আর সারাদিনের জন্য শরীরে শক্তির যোগান হয়। কিন্তু রাতের বেলায় তো এতো শক্তির দরকার নেই। ডিনারে সবুজ শাকসবজি খেয়ে সাথে সাথে শুয়ে পড়লে ঘুম কিন্তু সহজে আসবে না।
১৫. মূত্ররেচক খাদ্যঃ
শসা, গাজর, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি হচ্ছে মূত্ররেচক খাদ্য। পুষ্টিকর এই খাবারগুলো শোয়ার আগে খেলে বেশি বেশি প্রস্রাব হবে এবং ঘুম নষ্ট হবে।