প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা ঘুম শরীরের জন্য ভীষণ দরকারী। ঘুম ঠিকমতো না হলে দেহে স্থূলতা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, হাইপারটেনশন সহ নানা কঠিন রোগ বাসা বাঁধে। ইনসমনিয়ার রোগীরা, অর্থাৎ যাদের একদমই ঘুম হয় না, তাদের পক্ষে শরীর সুস্থ রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি ব্যাপার।
অনেকে সময়মতো ঘুমানোর পরেও নিবিড়ভাবে ঘুমাতে পারেন না। নানা কারণে হুটহাট ঘুম ভেঙে যায়। পরে পুনরায় ঘুমানো কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আনলে অনিদ্রার সমস্যা অনেকটাই নির্মূল করা সম্ভব।
আপনি কি অনিদ্রায় ভুগছেন? তাহলে আপনার জন্য নিয়ে এসেছি ঘুম উদ্রেককারী খাবারের একটি তালিকা। তালিকায় থাকা এই ৬টি খাবার খেলে অনিদ্রা দূর হবে নিশ্চিত। এই সুবিধা দামী দামী ওষুধ ও ডাক্তারি ট্রিটমেন্ট থেকে পাওয়ার চান্স কম।
১. বাদামঃ
টাইপ ২ ডায়বেটিস ও হার্ট ডিজিজের মতো সমস্যায় বাদামের অবদান অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি এই খাদ্য অনিদ্রার জন্য সমানভাবে কার্যকরী। এক মুঠো বাদাম ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, এবং মেলাটোনিনের সমাহার। প্রতিদিন ১ আউন্স বাদাম অনিদ্রার সমস্যা দূর করবে।
বাদামের মধ্যে আমন্ড মেলাটোনিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে পরিচিত। মেলাটোনিন আমাদের শরীরকে ঘুমের সময় সম্পর্কে অবগত করে এবং ঘুমাতে সাহায্য করে৷ শুধু তাই নয়, আমন্ডে প্রচুর পরিমানে ম্যাগনেসিয়াম আছে। ম্যাগনেসিয়াম ঘুম গাঢ় করার জন্য সহায়ক।
তাই ইনসমনিয়া রোগীদের বেশি করে আমন্ড খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা৷ আবার ম্যাগনেসিয়ামের কারণে শরীরে ইনফ্লেমেশন কমে যায়৷ এতে শরীরে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের উৎপাদন থেমে যায়। স্ট্রেস কম হওয়ার কারণে ঘুমটাও ভালো হয়। আমন্ডে সুগার ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকায় ঘন ঘন প্রস্রাব বা বদহজমের সমস্যা হয় না। ফলে বারবার ঘুম ভেঙে যায় না।
আরেক ধরণের উপকারী বাদাম হচ্ছে ওয়ালনাট। ওয়ালনাটে মেলাটোনিন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, কপার, সেরোটোনিন বিদ্যমান। এসব উপাদান স্লিপ প্রোমোটিংয়ের কাজে লাগে। ওয়ালনাটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর ফ্যাটি অ্যাসিডস। নিয়মিত এই বাদাম সেবনে আলফা-নিলোনেলিক অ্যাসিড নামক একটি ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে উৎপাদন হয়। এই ফ্যাটি অ্যাসিড পরে DHA তে কনভার্ট হয়, যা সেরোটোনিন উৎপাদন বাড়ায়।
২. দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যঃ
দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারে চার ধরণের স্লিপ-প্রোমোটিং উপাদান থাকে – ট্রিপটোফান, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, এবং মেলাটোনিন। দিনের চাইতে রাতের বেলা গরুর দুধ দোয়ালে দুধে মেলাটোনিনের পরিমাণ বেশি হয়। রাতে শোবার আগে হালকা এক্সারসাইজ ও এক গ্লাস গরম দুধ ঘুমের সমস্যায় ভোগা বয়স্কদের জন্য বেশি উপকারী। গরম দুধ মস্তিষ্কের স্নায়ু শিথিল করে আরাম দেয়।
দুধের পাশাপাশি পনির, দই খেলেও উপকার পাওয়া যাবে। তবে প্লেইন দুধের চাইতে মল্টেড দুধ ঘুমের জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো। মল্টেড দুধ বানাতে মল্টেড মিল্ক পাউডার লাগে। এই পাউডার তৈরি হয় ময়দা, মল্টেড আটা, মল্টেড বার্লি, চিনি, এবং অ্যাসোর্টেড ভিটামিনস দিয়ে। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হরলিক্স হচ্ছে মল্টেড মিল্ক পাউডার। তাই ঘুমের আগে এক গ্লাস হরলিক্স মেশানো দুধ খেতে হবে প্রতিদিন।
৩. সাদা চালঃ
সাদা চাল পলিশড থাকে বলে সেখানে পুষ্টিগুণ কম থাকে। তবুও এতে কিছু পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনড্রেক্স অনেক বেশি। মেলাটোনিনের মতো এই উপাদানও ঘুম গাঢ় করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রাতে রুটি বা নুডলস খায়, এদের চাইতে যারা রাতে ভাত খায় তাদের ঘুম ভালো হয়। বেশি ভাত খেলেও অনেকক্ষণ ঘুমানো যায় এমন দাবিও করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে শুধু সাদা ভাতের কার্বোহাইড্রেট ঘুম বাড়ায় না, এর সাথে যা খাওয়া হয় সেসবও ঘুম উদ্রেক করে। ভাতের সাথে প্রোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিডের একটি আইটেম থাকলে তা ঘুম উদ্রেককারী হরমোনের উৎপাদন নিশ্চিত করে। মুরগীর মাংস বা টার্কি খাওয়া উচিত ভাতের সাথে। টার্কিতে ট্রিপটোফানের পরিমাণ বেশি থাকে। বেশি ভাত না খেয়ে পরিমাণমতো ভাত ও প্রোটিন খেতে হবে।
৪. অধিক ফ্যাটযুক্ত মাছঃ
মাছ প্রোটিন ও ভিটামিন ডি-এর উৎকৃষ্ট উৎস। ঘুম বাড়ানোর জন্য অধিক ফ্যাটযুক্ত মাছ খাওয়া উচিত। স্যামন, টুনা, ট্রাউট, ম্যাকারেল ইত্যাদি হচ্ছে ফ্যাটি ফিশ। এগুলোতে ভিটামিন ডি এবং ওমেগা-৩ অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্যাটি ফিশের অতিরিক্ত ভিটামিন ডি এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে সেরোটোনিন উৎপাদনের হার বাড়িয়ে দেয়। সেরোটোনিন দেহঘড়িতে ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট টাইমটেবিল সেট করে দেয়। ফলে ঘুম সময়মতো হয়, আর সারাদিন শরীর চাঙ্গা থাকে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডি এবং ওমেগা-৩ এর আধিক্যের কারণে হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ উন্নত হয়। হার্ট সুস্থ থাকলে আরামে ঘুম হয়। তাই সপ্তাহে অন্তত তিনবার ফ্যাটি ফিশ খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
৫. টক চেরিঃ
মিষ্টি চেরির চাইতে টক চেরিতে স্লিপ-ইনডিউসিং প্রোপার্টিজ বেশি থাকে। টক চেরিতে বিদ্যমান মেলাটোনিন, ট্রিপটোফান, পটাশিয়াম, সেরোটোনিন, এবং পলিফেনলের কারণে ইনফ্লেমেশন ও মাসল পেইন কমে। শরীর রিল্যাক্স থাকার কারণে ঘুমটা আরামের হয়। এছাড়াও এই উপাদানগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধন করে।
দীর্ঘদিন ধরে ইনসমনিয়ায় ভোগা রোগীদের নিয়মিত টক চেরি খাওয়া উচিত। প্রাপ্তবয়স্কের জন্য খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে ৮ আউন্স করে সপ্তাহে দুইবার টক চেরি বা এর জুস খাওয়া। এভাবে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই নিয়মে টক চেরি খেলে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুম বেশি হয়। শোবার আগে চেরি জুস খেলে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়।
৬. ক্যামোমাইল টি
ইনসমনিয়ার জন্য ক্যামোমাইল টি একটি ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসা৷ ধারণা করা হয়ে থাকে যে এতে বিদ্যমান এপিজেনিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায়। শরীর ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় আর অনিদ্রার সমস্যা দূর হয়ে যায়।
এই চায়ে থাকা ফ্ল্যাভোনস ক্যান্সার এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ক্যামোমাইল চা পানে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ত্বক সুন্দর হয়, অবসাদ এবং উদ্বিগ্নতা দূর হয়। যারা ডিপ্রেশনের কারণে রাতে ঘুমাতে পারেন না তারা আজ থেকেই ক্যামোমাইল চা খাওয়া শুরু করে দিবেন। অবশ্যই শোয়ার আগে গরম চা খেতে হবে। ২০১১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন দুইবার ২৫০ মিলিগ্রাম করে ক্যামোমাইল নির্যাস এক মাস পর্যন্ত খেলে নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগে ঘুম চলে আসে। আর মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায় না।