লঙ্কা আবিষ্কারের গল্প বোধহয় যেন খানিকটা সেই আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই। বা বলা ভাল, আমেরিকা আবিষ্কারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে লঙ্কা আবিষ্কারের গল্পই। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর দীর্ঘ আমেরিকা আবিষ্কারের যাত্রাপথে হিসপ্যানিয়োলা দ্বীপপুঞ্জে প্রথম লঙ্কার সন্ধান পান। মনে করা হয়, দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে নাকি প্রথম উৎপত্তি হয় লঙ্কার, তারপর সে আশ্চর্য ‘ফল’ যে কীভাবে কলম্বাসের হাত ধরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল, সে কাহিনি রোমাঞ্চকর।
ভারতে লঙ্কার প্রচলন শুরু হয় পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরে। তার আগে মানুষ রান্নায় ঝাল দিয়ে গোলমরিচকেই ব্যবহার করতেন। সারা পৃথিবীতে লঙ্কার যে কতরকম প্রজাতি রয়েছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। গিনেস বুক অফ ওয়র্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল লঙ্কা ক্যারোলিনা রিপার, আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনা প্রদেশে এর উৎপত্তি। কিন্তু জানেন কি, ভারতেও এমন কিছু লঙ্কা রয়েছে, যেগুলিকে বিশ্বের অন্যতম ঝাল লঙ্কার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক।
১. ভূত জোলোকিয়াঃ
এটিকেও অনেকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল লঙ্কার আখ্যা দিয়ে থাকেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে এই লঙ্কা পাওয়া যায়। ভূত জোলোকিয়া লঙ্কাকে শুকিয়ে বা আঁচার করে সেখানকার মানুষজন খেয়ে থাকেন। এই লঙ্কাগুলিকে দেখতেও কিন্তু খুব অদ্ভুত হয়। স্কোভিল হিট ইউনিট (ঝাল মাপার একক)-এ এর ঝালের পরিমাপ হল ১০৪১৪২৭ ইউনিট।
২. নাগা লঙ্কাঃ
এই ঝাল লঙ্কাটি নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে উৎপন্ন হয়। নাগা মরিচ দেখতে ছোট হলেও এর ঝাল মারাত্মক। অনেকটা ভূল জোলোকিয়ার মতোই দেখতে বলে অনেকে নাগা মরিচকে ভূত জোলোকিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।
৩. জ্বালা লঙ্কাঃ
আক্ষরিক অর্থেই এই লঙ্কা খেলে আপনি ঝালে জ্বলে যেতে বাধ্য! এই লঙ্কা গুজরাতে উৎপন্ন হয় এবং সারা ভারত জুড়েই এই লঙ্কা বেশ জনপ্রিয়। এর স্কোভিল হিট ইউনিট ২০০০০ থেকে ৩০০০০-এর মধ্যে।
৪. গুন্টুর লঙ্কাঃ
গুন্টুর লঙ্কা মূলত অন্ধ্রপ্রদেশে উৎপন্ন হয়। গুন্টুর জেলায় উৎপন্ন হয় বলে এর এই নাম। বিখ্যাত এই লাল লঙ্কার গুঁড়ো মধ্যপ্রাচ ও লাতিন আমেরিকাতেও রফতানি করা হয়। অন্ধ্রপ্রদেশের এই লঙ্কাকে জিআই ট্যাগের আওতাতেও আনা হয়েছে।
৫. কান্থারি লঙ্কাঃ
কেরলের এই লঙ্কা মূলত বার্ডস আই চিলিস নামেই পরিচিত। শুধু কেরল না, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাংশেও এই লঙ্কা পাওয়া যায়। রান্নায় সেভাবে ব্যবহার করা না হলেও আঁচার ও চাটনি বানাতেই একে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের প্রথম ১০টি ঝাল লঙ্কার তালিকায় অবশ্যই এই লঙ্কাটি থাকবে।
৬. বেদগি লঙ্কাঃ
এই লঙ্কাটি মূলত কর্ণাটকে উৎপন্ন হয়। তবে এর জনপ্রিয়তা শুধু বর্তমানে কর্ণাটকেই সীমাবদ্ধ নেই, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই লঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম ঝাল। ঘন লাল রংয়ের এই লঙ্কা জিআই ট্যাগ পেয়েছে।
৭. ব্যাঙ্গালোর টর্পেডো চিলিঃ
নিরীহ সবুজ এই লঙ্কাটিকে দেখলে অনেকেই ভাবেন যে, এতে খুব একটা ঝাল নেই। কিন্তু ভারতে যে-সমস্ত ঝাল লঙ্কা পাওয়া যায়, এটি তার মধ্যে অন্যতম।
৮. মুন্ডু লঙ্কাঃ
গোটা তামিল নাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়েই এই মুন্ডু লঙ্কা উৎপন্ন হয়। এই লঙ্কা দেখতে অনেকটা গোল লাল কুলের মতো। এর খোসাও খুব পাতলা। মুন্ডু লঙ্কার স্বাদ অন্যরকম হওয়াও এটি অনেক রান্নাতেই একটি ইউনিক ফ্লেভার যোগ করে।
৯. ধানি লঙ্কাঃ
এই লঙ্কাটিকে অনেকে উত্তর-পূর্বের বার্ডস আই চিলিও বলে থাকেন। ডিপ লাল রংয়ের এই লঙ্কা মূলত মনিপুরে উৎপন্ন হয়। এই লঙ্কাটি কিন্তু বেশ ঝাল হয়। তাই রান্নায় ব্যবহারের বদলে স্থানীয় লোকেরা একে শুকিয়ে আঁচার বানিয়েই খেতে পছন্দ করেন।
১০. মাদ্রাজি লঙ্কাঃ
অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোর জেলায় এই লঙ্কা উৎপন্ন হয়। এই মাদ্রাজি লঙ্কা কিন্তু বেশ ঝাল। ফলে রান্নায় একে বুঝে-শুনে ব্যবহার করেন স্থানীয় মানুষজন।
১১. ডাল্লে খুরাসানিঃ
ভূত জোলোকিয়ার জাতভাই নামে পরিচিত এই লঙ্কা সিকিমের স্থানীয় রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এই লঙ্কা মূলত লাল রংয়ের, গোল আকারের হয়। মোমোর সঙ্গে যে ঝাল-ঝাল সস পরিবেশন করা হয়, সেটিও এই লঙ্কা দিয়েই বানানো।
তাহলে ভারতে উৎপন্ন এই ঝাল লঙ্কাগুলির মধ্যে কোন-কোনগুলি খেয়েছেন আপনি? আর কেমন ছিল সেই খাওয়ার অভিজ্ঞতা? জানাতে ভুলবেন না যেন।