গ্রিন টি-র উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই চা শরীরে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড জমতে দেয় না, মেটাবলিজমের মাত্রা বাড়ায়, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু সবসময় কি গ্রিন টি উপকারে আসে?
ভেজালের ভীড়ে এই উপকারী চা-ও নকল হওয়া শুরু করেছে। আর আর্টিফিসিয়াল গ্রিন টি খেলে শরীরের হাল কি হবে তা আর না-ই বললাম।
আসল গ্রিন টি চেনার উপায় জানা থাকলে আপনাকে আর নকলের খপ্পরে পড়ে স্বাস্থ্য খোয়াতে হবে না। আসল গ্রিন টি চেনার উপায় জেনে নিন।
১. পাতার আকারঃ
সাধারণত গ্রিন টি টি ব্যাগ আকারে কিনতে পাওয়া যায়, যা একদমই অরিজিনাল না। খাঁটি গ্রিন টি শুকনো পাতা হিসেবেই বিক্রি হয়। টি ব্যাগের চাইতে শুকনো পাতা স্বাদে ও মানে উন্নত থাকে। পাতার আকার দেখে কিনলে বিভ্রান্তি থেকে অনেকাংশেই বাঁচা সম্ভব।
প্রচলিত গ্রিন টি ব্যাগে অত্যধিক শুকনো ছোট ছোট কালো বা কালচে সবুজ রঙের পাতার টুকরা থাকে। আসল চা টি ব্যাগ ছাড়া কিনতে পাওয়া যায়৷ বেশিরভাগ সময়ে গাছের একদম কচি পাতা থেকে গ্রিন টি আসে। মাঝে মাঝে কচি পাতার পাশাপাশি উপরের দিকের কয়েকটি পাতা ব্যবহৃত হয়।
২. পাতার রংঃ
গ্রিন টি গ্রিন হয় অক্সিডেশন বা ফারমেন্টেশনের অভাবে। এতে চা পাতা কালচে বা বাদামি হয়ে যায় না। ব্ল্যাক টি বা কালো চা কালো দেখায় কারণ চা পাতাকে ফারমেন্টেশনের আওতায় আনা হয়। অক্সিডেশনে না থাকলে চা পাতার ক্লোরোফিল অটুট থাকে এবং গ্রিন টি সবুজ দেখায়।
বাগান থেকে পাতা তুলে সরাসরি তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শুকিয়ে গ্রিন টি করা হয়৷ আসল গ্রিন টি চিনতে চাইলে চা পাতার রং খেয়াল করুন। বাজারে গ্রিন টি বেশ চটকদার করে উপস্থাপন করা হয়। সেটি দেখতে মোটেও সবুজ লাগে না। অরিজিনাল গ্রিন টি দেখতে উজ্জ্বল, হালকা সবুজ রঙের হয়।
৩. অনুভূতিঃ
গ্রিন টি-র পাতা হাতে ধরে অরিজিনালিটি ও ফ্রেশনেস শনাক্ত করা সম্ভব। কিভাবে? চেক করে দেখুন পাতাটি আস্ত আছে কিনা এবং ধরতে মসৃণ কিনা। যদি পাতাটা ভাঙা বা কাটা থাকে, হাতের আলতো ছোঁয়ায় দুমড়ে যায় বা মুচমুচে হয়ে ভেঙে যায়, তাহলে বুঝবেন সেটি অনেক পুরনো কিংবা বেশি শুকানো হয়েছে।
চায়ের কোয়ালিটি ঠিক রাখতে হলে এমনভাবে তাপ দিতে হয় যেন শুকানোর পরেও মসৃণতা অটুট থাকে। অরিজিনাল, ফ্রেশ গ্রিন টি-র পাতায় গরম জল পড়লে আস্তে আস্তে মেলতে শুরু করে৷ যখন গ্রিন টি কিনবেন তখন হাতে কাটা চা পাতা দেখে কেনার চেষ্টা করুন। ভঙ্গুর, ছাতা পড়া পাতা কেনা বিরত থাকুন।
৪. প্রক্রিয়াজাতকরণঃ
নকল গ্রিন টি রাসায়নিক ও কীটনাশক দিয়ে মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে ক্ষতিকর ধুলাবালি ও উপাদানের পরিমাণও বেশি থাকে৷ আবার টি ব্যাগে ঢোকানোর কারণে চা পাতার পুষ্টিগুণ অনেকটা নষ্ট হয়। টি ব্যাগের ফিল্টার পেপারটা অনেক সময় স্বাস্থ্যসম্মত হয় না।
আসল গ্রিন টি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় না বললেই চলে। করা হলেও তাতে কৃত্রিম ও ক্ষতিকর উপাদান খুব কম থাকে। খাঁটি চায়ের প্যাকেটে এপিগ্যালোক্যাটেচিন লেখা থাকে, যেটা নকল চায়ের মোড়কে থাকবে না।
৫. স্বাদ ও গন্ধঃ
স্বভাবতই আসল গ্রিন টি-র স্বাদ ও গন্ধ নকলটির চাইতে আলাদা হবে। নকল চা খেতে স্বাদ লাগবে না, কোন উপকারও হবে না। আসল গ্রিন টি-র স্বাদ একদম আলাদা, মুখে দিলে বিভিন্ন রকমের স্বাদ পাওয়া যাবে। স্মুদিনেসের সাথে আসবে সতেজতা, চনমনে ভাব।
গন্ধের দিক থেকেও আসল গ্রিন টি সেরা৷ গরম জলের সংস্পর্শে আসলে কচি ঘাসের মতো হালকা এবং সতেজ ঘ্রাণ আসবে। আবার আসল গ্রিন টি তে বিদ্যমান এসেনশিয়াল অয়েল চা বানানোর পরে অটুট থাকে।
আসল চা যত দিন যাবে তত স্বাদ নষ্ট হতে থাকবে। কিন্তু নকল চা মাসের পর মাস গেলেও স্বাদ ও গন্ধ একইরকম থাকবে। আপনার কেনা গ্রিন টি যদি বানানোর পরে তেঁতো, পানসে, বা একঘেয়ে স্বাদ পান, গন্ধটাও যদি হয় সেরকম, বুঝে নিবেন নকল বা লো কোয়ালিটির চা কিনেছেন।
৬. চায়ের রংঃ
আগেই বলেছি আসল চা পাতার রং অসাধারণ হবে। সেটি ছিল কাঁচা অবস্থার কথা। এবারে জানুন চা ফোটানোর পরে রংয়ের পরিবর্তন কিরকম হবে সে সম্পর্কে। অরিজিনাল গ্রিন টি পাতা গরম জলে প্রথমে জলপাই সবুজ রং ধারণ করবে। কিছুক্ষণ পরে রং পরিবর্তন হয়ে হালকা সবুজ রংয়ে ফেরত আসবে, যেমনটি কাঁচা পাতার ছিল৷ যেসব গ্রিন টি-র প্রসেসিংয়ে ত্রুটি থাকে, সেগুলো ফোটানোর পরে বাদামি বা কালচে হয়ে যায়। পরবর্তীতে রংয়ের পরিবর্তন হয় না।
৭. চা পাতার মেয়াদঃ
গ্রিন টি কেনার ক্ষেত্রে মেয়াদ হচ্ছে বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি ব্যাপার। সাধারণত এই চায়ের চাষ হয় প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে। উৎপাদনকৃত চা উৎপাদনের সময় থেকে ৬-১২ মাসের বেশি রাখা যায় না। আসল উৎপাদনকারী বা বাগানীদের কাছ থেকে সরাসরি চা কিনলে মেয়াদ ঠিক থাকে।
কিন্তু দোকানের চা-তে মেয়াদ ঠিক থাকে না। প্যাকেটের গায়ে যে মেয়াদটা লেখা থাকে সেটি আসলে রি-সেলার কবে চা প্যাকেটজাত করেছে সেই তারিখ। রি-সেলারের কাছে পৌঁছানোর আগে গ্রিন টি কয়েক হাত ঘুরে আসে। যতদিনে রি-সেলার বা খুচরা ব্যবসায়ীর হাতে আসে, ততদিনে চায়ের মেয়াদ শেষের কোঠায় চলে যায়। তখন বিক্রির জন্য বাধ্য হয়ে বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে, মেশিনে প্রসেস করে চায়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
তাই অরিজিনাল গ্রিন টি কিনতে চাইলে বাগানের খোঁজ করুন। বাগানী কবে চা তুলে প্রসেস করেছে এবং তা কতদিন পর্যন্ত ভালো থাকবে এসব সম্পর্কে সঠিক তথ্য মোড়কে পাবেন।
আসল জাপানিজ গ্রিন টি (মাচা) চেনার উপায়ঃ
মাচা বা জাপানিজ গ্রিন টি হচ্ছে পাউডারড চা। জাপানে উৎপাদিত গ্রিন টি-র পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মাচা তৈরি হয়। যদিও চীন ও তাইওয়ানে মাচা উৎপাদিত হয়, তবুও জাপানি মাচা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট এবং উত্তমভাবে পরীক্ষিত। মাত্র তিনটি উপায়ে আসল মাচা চিনতে পারবেন।
১. পাউডারের রংঃ
অরিজিনাল এবং হাই কোয়ালিটির মাচার রং থাকে উজ্জ্বল হালকা সবুজ। ইংরেজিতে যাকে বলে স্প্রিং গ্রিন কালার। মাচা তৈরির আগে পাতাগুলোকে ৩ সপ্তাহ ছায়ায় রাখতে হয়। এতে ক্লোরোফিল পাকাপোক্ত হয় এবং চায়ের আসল রং চলে আসে।
যদি পাউডারের রং বাদামি, মেটে হলুদ, বা ম্যাড়মেড়ে লাগে, তাহলে সেটি লো কোয়ালিটি, অনেক দিনের পুরনো, ভেজাল দেয়া, বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মাচা। পাতা ছায়ায় না রাখলে মাচার রং বিবর্ণ হয়ে যায়। আবার গাছের নিচের অংশের পাতা দিয়ে মাচা বানালেও রং ভিন্ন দেখায়।
২. টেক্সচারঃ
আসল জাপানিজ গ্রিন টি পাউডার হাতে ধরতে খুবই মসৃণ লাগবে, অনেকটা ট্যালকম পাউডারের মতো। কোন দানা বা গুটি থাকবে না এবং খসখসে ভাব অনুভূত হবে না। নকল বা লো কোয়ালিটির গ্রিন টি পাউডারের টেক্সচার থাকবে সম্পূর্ণ বিপরীত।
৩. দামঃ
উৎকৃষ্ট এই জাপানিজ টি পাউডারের দাম শুনতে আঁতকে উঠবেন। ১ আউন্সেরই দাম পড়তে পারে কয়েক হাজার টাকা। লো কোয়ালিটির মাচা কিনতে গুনতে হতে পারে কয়েকশো টাকা। অরিজিনাল মাচা কদাচিৎ অফার প্রাইসে বা সেলে হয়তো পাবেন। আবার এটি কিন্তু সহজলভ্য হবে না। কিন্তু আর্টিফিসিয়াল মাচা সবসময়ই পাবেন জলের দামে। দামের ব্যাপারটা নরমাল গ্রিন টি-র ক্ষেত্রেও একই। ভালো মানের গ্রিন টি-র দাম বেশি এবং তা দিয়ে চা বানাতেও একটু সময় লাগে।