খাবার পাতে লেবু স্বাদবর্ধক হিসেবে কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে এর উপকারিতা অনেক। ভিটামিন সি-এর একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে পরিচিত লেবুর রস ও খোসা উভয়ই শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আজকে কথা বলব দৈনন্দিন জীবনে লেবুর উপকারিতা সম্পর্কে। আরো জানতে পারবেন লেবু থেকে কি কি ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত এই আর্টিকেল থেকে। সুতরাং স্কিপ না করে পড়ে ফেলুন পুরো আর্টিকেলটি।
ক. লেবুর উপকারিতাঃ
১. ওজন কমায়ঃ
লেবুর রস মেশানো জল ওজন কমাতে দারুণ সহায়ক। নিয়মিত লেবুর জল খেলে ওজন কমবে। খাওয়ার আগে ও মাঝখানে লেবুর জল খেলে পেট ভরা থাকবে। ফলে বেশী খাওয়ার তাগিদ থাকবে না, ক্যালরি গ্রহণ কম হবে। অনেকে সকালবেলা খালি পেটে হালকা গরম জলে লেবু ও মধু মিশিয়ে খান। এই জল শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। ভারী বা চর্বিযুক্ত খাবারের সাথে লেবু খেলে শরীরে চর্বি জমতে পারে না, ওজনও থাকে নিয়ন্ত্রণে।
২. হজম ত্বরান্বিত করেঃ
হজমের সমস্যায় ও কোষ্ঠকাঠিন্যে লেবু খেলে উপকার পাওয়া যায়। লেবুর জল পরিপাক সংক্রান্ত এনজাইমগুলো সক্রিয় করে হজমক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। আবার প্রতিদিন সকালে যারা লেবুর জল খান তাদের রেচনতন্ত্র যারা লেবুর জল খান না তাদের তুলনায় সচল ও সুস্থ থাকে। অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার সময় লেবুর রস ছিটিয়ে নিলে খেতে অস্বস্তি হয় না। সেই সাথে খাবার দ্রুত হজম হয়। আর খাবার সহজে হজম হলে কোষ্ঠকাঠিন্যও থাকে দূরে।
৩. কিডনি সুস্থ রাখেঃ
লেবুর জল শরীর থেকে বাড়তি তরল অপসারণ করে এবং মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। সকালে খালি পেটে লেবুর জল খেলে কিডনি থেকে টক্সিন প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়। এতে কিডনি সুস্থ থাকে আর পেটের ফোলা ভাব কমে যায়। পাশাপাশি কিডনিতে যখন অক্সালেট কিডনি স্টোন হয় তখন লেবুর জলে উপস্থিত সিট্রেইট সেই পাথর ভেঙে ফেলে এবং দ্রবীভূত করে৷
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়েঃ
নিয়মিত লেবু খেলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। প্রতিদিন ১টি লেবু একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণ করে। নিয়মিত লেবুর জল পানে শরীরের দুর্বলতা কমে যায়। লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেকোন ধরণের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে৷ আবার এটি ভেজাল খাবার ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হওয়া রোগের মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে। ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ছাড়াও লেবুতে আছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, এবং অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম। এসব উপাদান দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৫. ঠান্ডার সমস্যা কমায়ঃ
সর্দি-কাশি ও অন্যান্য ঠান্ডাজনিত সমস্যা সমাধানে লেবুর ভূমিকা অপরিসীম। হুটহাট হালকা সর্দি-কাশিতে ওষুধের বিকল্প হিসেবে লেবুর রস খাওয়া যেতে পারে। লেবুতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে তা সাধারণ ঠান্ডা ও ফ্লু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। প্রকৃত অর্থে লেবু সর্দি-কাশি সারায় না, বরং এটি সর্দি-কাশি শরীরে যাতে বেশীদিন না থাকে তার জন্য কাজ করে। কাশি বা সর্দি হলে এক গ্লাস গরম জলে ১ টেবিল চামচ মধু ও এক টুকরো লেবুর রস চিপে খেলে আরাম বোধ হবে।
৬. রক্তের রোগ দূরে রাখেঃ
রক্তের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে লেবু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীর থেকে টক্সিন বের করে বিধায় লেবুর জল রক্ত পরিষ্কার রাখতেও সাহায্য করে। সেই সাথে লেবুতে বিদ্যমান পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার নিয়মিত লেবু খেলে রক্তশূন্যতার ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যায়।
৭. ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ
লেবুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের ক্ষতি রোধ করার মধ্য দিয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। তবে লেবুর রসের চাইতে লেবুর খোসা ক্যান্সার প্রতিরোধে অধিক কার্যকরী। কারণ লেবুর খোসায় আছে সালভেস্ট্রোল কিউ৪০ এবং লিমনিন নামক দুটি উপাদান। এগুলো ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে। লাল চায়ে লেবুর খোসা ব্যবহার করলে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত হয়। আবার লেবু বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লেবুর খোসা ত্বকে প্রয়োগ করলে স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৮. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাইট্রাস বা ভিটামিন সি যুক্ত ফল হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এবং তা পুরুষদের চাইতে মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশী কার্যকর। নিয়মিত লেবু খেলে কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়াও লেবুর খোসায় বিদ্যমান পলিফেনল ফ্ল্যাভোনয়েড শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। কোলেস্টেরল যখন নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন হৃদরোগ অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।
৯. দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখেঃ
দাঁত ও মাড়ির বিভিন্ন সমস্যার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ না করা। ভিটামিন সি এর অভাবে মাড়িতে ঘা, মাড়ি থেকে রক্তপাত, মুখে ঘা ইত্যাদি অনেক রোগ হয়। লেবু এসব রোগ দূরে রাখতে সক্ষম।
১০. হাঁপানি প্রতিরোধ করেঃ
লেবু সাময়িক সর্দি-কাশি সারানোর সাথে সাথে হাঁপানির সংক্রমণও কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন সি ব্রঙ্কিয়াল হাইপারসেনসিটিভিটি উপশমের জন্য কার্যকরী। হাঁপানি রোগীদের মধ্যে যারা প্রায়ই সর্দি-কাশিতে ভোগেন তারা প্রতিদিন একটি করে লেবু খেতে পারেন। সেই সাথে ভিটামিন সি যুক্ত অন্যান্য খাবারও খেয়ে দেখতে পারেন, উপকার পাবেন।
১১. আয়রনের পরিমাণ বাড়ায়ঃ
লেবু মানবদেহে রক্তশূন্যতা কমায় আয়রনের পরিমাণ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেলে রক্তস্বল্পতা কমে ঠিকই, তবে এর সাথে ভিটামিন সি যোগ করলে আরো সুফল পাওয়া যায়। ভিটামিন সি আয়রনের পরিপূরক হিসেবে পরিচিত। সেই সাথে ভিটামিন সি দেহে আয়রন দ্রুত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে শোষণে সাহায্য করে। তাই রক্তস্বল্পতা হলে প্রতিবার আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের সাথে একটি করে লেবু খেতে হবে। এতে দেহে আয়রন ও ভিটামিন সি উভয়ই প্রবেশ করবে।
১২. হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ করেঃ
লেবুর খোসায় উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, এবং ক্যালসিয়াম হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে। লেবুর খোসার পাউডারের টনিক, লেবুর রস ভাতে মেখে, অথবা লেবুর শরবত করে খাওয়া যেতে পারে হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য। নিয়মিত লেবু খেলে অল্প বয়সে অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, পলিআর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
১৩. সৌন্দর্য বাড়ায়ঃ
সৌন্দর্য রক্ষার্থে লেবুর জুড়ি মেলা ভার। এর ভিটামিন সি, সাইট্রিক অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, এবং অ্যান্টি-এজিং প্রোপার্টিজ বলিরেখা কমায়, সেবাম ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে, দাগ দূর করে, আর্দ্রতা বজায় রাখে, মৃত কোষ ঝরায়, এবং ত্বককে সজীব, কোমল, ও উজ্জ্বল করে। ত্বকের যত্নে লেবু দিয়ে ফেস প্যাক, টোনার, ফেসিয়াল ইত্যাদি করা যায়। এছাড়াও লেবুর রস চুলের গোড়া পরিষ্কার ও শক্ত করে৷ সেই সাথে চুলকে বানায় কোমল, মসৃণ, এবং উজ্জ্বল৷ কাজ করতে করতে হাতে কড়া পড়ে গেলে গোলাপজল ও লেবুর রসের মিশ্রণ হাতে মাখবেন। এছাড়াও হাতের রুক্ষতা দূর করতে টমেটোর রস, কাঁচা দুধ, এবং লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে স্নানের আগে ১৫-২০ মিনিট লাগিয়ে রাখবেন।
খ. লেবুর অন্যান্য উপকারিতাঃ
- আপেল বা অ্যাভোকাডোর কাটা অংশে লেবু মাখিয়ে রাখলে সহজে বাদামি হয়ে যাবে না।
- সিঙ্ক থেকে দাগ দূর করতে প্রথমে বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিন। এরপরে লেবুর খোসা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে নিন। সিঙ্ক নতুনের মতো চকচক করবে।
- একটি লেবু কেটে দুইভাগ করে কাটা অংশে লবঙ্গ গেঁথে ঘরের এক জায়গায় রেখে দিন। মশার উপদ্রব কমে যাবে।
- যেসব কোণা বা ছিদ্র দিয়ে পিঁপড়া ও অন্যান্য পোকামাকড় ঘরে প্রবেশ করে সেসব জায়গায় কয়েক টুকরো লেবুর খোসা রেখে দিন। পোকামাকড়ের উপদ্রব কমে যাবে।
- রোজমেরি অয়েল, ভ্যানিলা অয়েল, লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে এয়ার ফ্রেশনার বানাতে পারেন। ঘর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বা দুর্গন্ধ চলে যাবে৷
- লেবুর খোসা ফ্রিজে রাখলে দুর্গন্ধ দূর হবে। খোসার বদলে লেবুর টুকরোও রেখে দিতে পারেন, এটি সব বাজে গন্ধ অ্যাবজর্ব করে নিবে।
- মেটাল বা কাচের বাসনকোসন ধোয়ার সময় লেবুর খোসায় ডিশওয়াশার লাগিয়ে ঘষবেন। জেদি দাগ-ময়লা সব চলে যাবে৷
- কাপড় থেকে ঘামের দাগ দূর করার জন্য দাগের জায়গায় অর্ধেক রস বের করে নেয়া লেবু ঘষে নিন। এরপর এতে বেকিং সোডা ছিটিয়ে সারারাত রেখে দিন৷ সকালে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
গ. লেবুর অপকারিতা হতে সাবধানঃ
- লেবু একটি হাই-অ্যাসিডিক খাদ্য উপকরণ। যারা আগে থেকেই বা ঘন ঘন হার্ট বার্ন, স্টোমাক আলসার, বা মাউথ আলসারে ভোগেন তাদের লেবু না খাওয়াই ভালো। খেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাবেন।
- শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশী থাকলে লেবু খাওয়া যতটা সম্ভব কমিয়ে দিবেন।
- বহু পুরনো কিডনির অসুখ থাকলে লেবু এড়িয়ে চলতে হবে।
- সেনসিটিভ স্কিনে লেবু জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেনসিটিভ স্কিনে লেবু প্রয়োগ করবেন না। যদি করেও থাকেন তাহলে সূর্যের দিকে মুখ রাখবেন না। এমনকি সাধারণ ত্বক হলেও রোদে বেরোনোর আগে লেবু প্রয়োগ করবেন না ত্বকে।
- লেবু হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করলেও এটি ক্ষয়ে যাওয়া হাড়ের জন্য ক্ষতিকর। বয়ষ্কদের মধ্যে যারা হাড় ক্ষয় রোগে ভুগছেন তাদের নিয়মিত লেবু খাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে। কারণ লেবু হাড়ের জয়েন্টের রস শুকিয়ে ফেলে।
- দীর্ঘদিন ধরে হালকা গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়।
- অতিরিক্ত লেবু খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা থেকে দেহে ডিহাইড্রেশন দেখা দিতে পারে।
- লেবু যেহেতু একটি অম্লীয় খাবার, সেহেতু অতিরিক্ত লেবুর রস খেলে পেটে গোলযোগ দেখা দিতে পারে।
- লেবু দেহে আয়রনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা শরীরের জন্য খুবই বিপদজনক।