ছোটবেলায় পপাই দ্য সেইলর কার্টুনটা দেখেছেন নিশ্চয়ই? গাট্টাগোট্টা ভিলেন ব্লুটোর মোকাবেলা করতে পপাই এক কৌটা পালং শাক খেয়ে নেমে পড়তো। আর ব্লুটোকে একহাত দেখে নিতো। কার্টুনে মজার ছলে দেখানো হলেও বাস্তবে পালং শাকের উপকারিতা ঠিক এরকমই কড়া। এই একটি শাক থেকেই পাওয়া যাবে অনেক রোগবালাই থেকে মুক্তি। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পালং শাক খাওয়া একেবারেই উচিত না। এই আর্টিকেল থেকে জানতে পারবেন পালং শাক এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত।
১. রক্তের সমস্যা দূর হয়ঃ
পালং শাকের নাইট্রোজেন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়াও পালং শাকে প্রোটিন রয়েছে যা রক্তচাপ বাড়তে দেয় না। ফলে রক্তচাপের সাথে সম্পৃক্ত সকল শারীরিক সমস্যা দূরে হয়। একইসাথে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে যায়।
আমাদের শরীরে যখন আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হয়। অ্যানিমিয়া হলে লোহিত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। কাজেই লোহিত কণিকার ঘাটতি পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনের উপস্থিতি জরুরী। আর এজন্য নিয়মিত পালং শাক খাওয়া উচিত। এছাড়াও আয়রন পেশীর শক্তি বর্ধন ও এর সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।
২. সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়ঃ
আয়রনে ভরপুর পালং শাক চোখের নিচের কালো দাগ দূর করে। আবার এর ভিটামিন সি ত্বক আর্দ্র রাখে, ব্রণ কমায়, স্কিন টোন উন্নত করে, এবং ফ্রি র্যাডিক্যাল ড্যামেজের বিরুদ্ধে কাজ করে। পালংয়ে আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড যা বলিরেখা দূর করে এবং ইউভি রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেয়।
চুল পড়া সমস্যার সমাধানে পালং শাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়াম আছে যা চুল পাতলা হয়ে ঝরে পড়া আটকায়। আবার এই দুইটি খনিজ পদার্থ চুলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে। ত্বক ও চুলের যত্নে পালং শাক সরাসরি খেতে পারেন বা প্যাক বানিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
৩. দৃষ্টিশক্তি উন্নত হয়ঃ
আমাদের চোখে রেটিনার কেন্দ্রবিন্দুকে বলা হয় ম্যাকুলা। এই ম্যাকুলায় পিগমেন্টের ডেনসিটি যখন কমে যায় তখন দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেয়। পালং শাকে আছে লুটেইন ও জেক্সানথিন নামক দুইটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান এবং ভিটামিন এ ও সি।
এগুলো ম্যাকুলার ক্ষয় কমায় এবং এর পিগমেন্ট ডেনসিটি উন্নত করে। ফলে নানাবিধ চোখের অসুখ থেকে চোখ থাকে সুস্থ। চোখ ঠিক রাখতে ডাক্তাররা সবুজ শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই পালং শাক চোখের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য খাওয়া জরুরী।
৪. ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ
ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য পালং শাক সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এটি বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ হওয়ায় শরীরে ক্যান্সার কোষের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার এই শাকের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য ফ্রি র্যাডিক্যাল এবং কার্সিনোজেন প্রতিরোধ করে।
সতর্কতাঃ ধূমপায়ীদের জন্য পালং শাক নিরাপদ না। কারণ এর বিটা ক্যারোটিন ধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৫. মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর কার্যাবলী উন্নত হয়ঃ
পালং শাকের ক্যালসিয়াম স্নায়ুতন্ত্রের জন্য উপকারী। এর সাথে শাকে বিদ্যমান ভিটামিন কে, লুটেইন, ফোলেট, এবং বিটা ক্যারোটিন মস্তিষ্ক গঠন করে, সুস্থ রাখে, এবং স্মৃতিশক্তি শক্তিশালী করে। তাই যেকোন বয়সের মানুষ এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য পালং শাক খাওয়া অত্যাবশ্যক।
৬. হৃদরোগের ঝুঁকি কমেঃ
নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ শাকসবজি হৃদরোগের যাবতীয় জটিলতা কমাতে সক্ষম। পালং শাক নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এই শাক স্ট্রোক এবং অন্য কোন হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
সতর্কতাঃ পালং শাকে ক্যালসিয়াম অনেক বেশি থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়ঃ
ছোটবড় নানা ধরণের রোগ দমনে পালং শাকের জুড়ি নেই৷ পালং শাকের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এটি প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে। এর অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য ক্ষতস্থানের ব্যথা ও ফোলা ভাব কমাতে সাহায্য করে। পালংয়ে যতটুকু ভিটামিন ই থাকে তা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সক্ষম।
শরীরে যখন অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম জমা হয়, তখন সেগুলো শক্ত কোষ আকারে প্রকাশ পায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়া ক্যালসিফিকেশন নামে পরিচিত। ক্যালসিফিকেশনে উপকারের চাইতে ক্ষতিই বেশি, কারণ সেটি প্রদাহের সৃষ্টি করে৷ আয়রন এবং অক্সালিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ পালং শাক ক্যালসিয়ামের এই কাঠিন্য বন্ধ করতে সহায়তা করে।
৮. হাড় সুস্থ রাখেঃ
ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত ও সুগঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। পালং শাকে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম হাড়ে পুষ্টি যোগায়, হাড়ের বৃদ্ধি ঘটায়, এবং হাড় শক্ত করে। আবার ক্যালসিয়াম শরীরের ক্লান্তি দূর করতেও সক্ষম। তাই কাজের চাপে শরীর সহজে ভেঙে পড়ে না। তাই খাদ্য তালিকায় অন্যান্য ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি পালং শাক রাখা জরুরি। নিরামিষভোজীদের জন্য পালং শাক ক্যালসিয়ামের সহজলভ্য একটি উৎস।
৯. পরিপাকতন্ত্র সুস্থ থাকেঃ
পালং শাক হজমক্রিয়া ঠিক রাখার মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং জল। ফাইবার খাদ্য হজম করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ফলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়।
সতর্কতাঃ পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং অক্সালেট আছে। পটাশিয়ামের আধিক্যে বমি, ডায়রিয়া হতে পারে। কিডনি জটিলতায় ভোগা রোগীদের পালং শাক খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
১০. গর্ভাবস্থা নিরাপদ করেঃ
গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। আর তাদের খাবারে পালং শাক থাকলে তা মা ও শিশু দুজনেরই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম। ভ্রুণের জন্মগত স্নায়ুবিক ত্রুটি রোধ করতে ফোলেট খুব জরুরী, যা পালং শাকে পাওয়া যায়৷
এছাড়াও গর্ভবতী মায়ের শরীরের জন্য আয়রন, ক্যালসিয়াম, এবং ফাইবারের দরকার হয়। এতে মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা দূর হয়, পর্যাপ্ত বুকের দুধ উৎপাদন হয়, এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। আর এই সব পুষ্টি নিশ্চিত করবে পালংশাক।
সতর্কতাঃ পালং শাকের ভিটামিন এ-র আধিক্যের কারণে শিশুর জন্মগত বিকৃতির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
১১. ওজন কমেঃ
অতিরিক্ত ওজনের কারণে মানবদেহে নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয়৷ তাই ওজন কমানোর জন্য পালং শাক খাওয়া যেতে পারে। আবার ওজন একটি নির্দিষ্ট মাপে বজায় রাখার জন্যও পালং শাক কাজে লাগবে।
পালং শাকে ফাইবার বেশি কিন্তু ক্যালরি কম। এই শাক পেটে অনেকক্ষণ থাকবে, আবার ক্যালরি কম থাকার কারণে শরীরে মেদও জমবে না। ডায়েটে পালং শাক অন্তর্ভুক্ত করলে ওজন কমানো সহজ হয়ে যায়।
সতর্কতাঃ অতিরিক্ত ফাইবার পেট ফাঁপা ও ক্র্যাম্পের সৃষ্টি করতে পারে।