দিন দিন বাড়ছে মানুষের কর্মব্যস্ততা, আর এই কর্মব্যস্ত জীবনে একটুখানি স্বস্তির ছোঁয়া পেতে মানুষ আজকাল অনলাইনের প্রতি বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো, পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া সবই হচ্ছে অনলাইনে।
করোনা মহামারীতে ঘরের বাইরে বিচরণ সীমাবদ্ধ হওয়াতে অনলাইন বিজনেসে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। আর বিভিন্ন বিজনেস আইডিয়ার মধ্যে ফুড বিজনেস সবচেয়ে এগিয়ে আছে। পোশাকি ভাষায় ফুড বিজনেস ‘ক্লাউড কিচেন’ বিজনেস নামে পরিচিত।
ক্লাউড কিচেন ব্যবসায় সুবিধা অনেক বেশী। একবার ব্যবসা ঠিকমতো ধরতে পারলে প্রতিমাসে ভালো একটা অ্যামাউন্ট রোজগার করা সম্ভব। আপনার যদি ক্লাউড কিচেনে ইনভেস্ট করার ইচ্ছা থাকে তাহলে আজকের আর্টিকেলটা আপনার জন্য। জানতে পারবেন ক্লাউড কিচেন কি এবং ক্লাউড কিচেন ব্যবসা কিভাবে শুরু করা যায় সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত।
ক্লাউড কিচেন কি?
সহজ কথায়, ক্লাউড কিচেন হচ্ছে অনলাইন রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টে নেই কোন বসার ব্যবস্থা, নেই কোন পার্টি বা অনুষ্ঠান করার সুযোগ, শুধু আছে খাবার অর্ডারের সুবিধা। খাবার অর্ডারের পুরো প্রসেসটা হয় অনলাইনের মাধ্যমে। ক্লাউড কিচেনে শুধু একটি রান্নাঘর, রাঁধুনী, এবং অল্প কয়েকজন সহযোগী থাকে। রাঁধুনীর রান্না করা খাবার সরাসরি গ্রাহকের দ্বারে পৌঁছে দেয় থার্ড পার্টি অ্যাপস বা ফুড অ্যাগ্রিগেটররা। এটাই হচ্ছে ক্লাউড কিচেনের সারসংক্ষেপ৷
ক্লাউড কিচেন ব্যবসা কিভাবে শুরু করা যায়
ক্লাউড কিচেন ব্যবসায় নামার আগে ফুল প্ল্যানিং করে নামা উচিত। শুধুমাত্র রান্না করে খাবার ডেলিভারি দেয়া – শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, কাজটা ততটাও সহজ না। নতুন অবস্থায় আপনার কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সেসব জানতে পারবেন নিচের প্যারাগ্রাফগুলো থেকে।
১. মেনু নির্বাচনঃ
মেন্যু নির্বাচন করতে হবে বেশ হিসাবনিকাশ করে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখবেন-
- কোথায়/কোন এলাকায় ক্লাউড কিচেনের ব্যবসা করবেন – অফিসপাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলাকা, নাকি আবাসিক এলাকায়?
- কাদের জন্য করবেন – চাকুরীজীবীদের জন্য, ছাত্রদের জন্য, গৃহিণীদের জন্য?
- কি ধরণের খাবার বানাবেন – দেশী, বিদেশী, ফাস্ট ফুড, থ্রি মিলস, নাকি শুধু ব্রেকফাস্ট/লাঞ্চ/ডিনার বা এর যেকোন দুইটি?
- গ্রাহকরা কি খেতে পছন্দ করে বা তাদের চাহিদা কি?
- আপনি কোন কোন খাবার ভালো বানাতে পারেন?
এই পাঁচটি ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করবে আপনার মেন্যু সিলেকশন এবং প্রাইস। আশেপাশের এলাকা, বাজার, এবং অফিসগুলোতে জরিপ করলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। প্রথম অবস্থায় অনেকগুলো ডিশ মেন্যুতে রাখবেন না৷ সুবিধামতো দুই-তিনটি ডিশ নিয়ে ব্যবসা চালু করুন। পরে ব্যবসার প্রসারের সাথে ডিশ বাড়ানো যাবে।
২. স্থান নির্বাচনঃ
ক্লাউড কিচেনের সবচেয়ে সুবিধা হলো, একটা রান্নাঘর আর কিছু লোকজন হলেই ব্যবসা দাঁড় করানো যায়। রেস্টুরেন্টের মতো অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল, গ্লাস-প্লেট কেনার ঝামেলা নেই। আর এই রান্নাঘর নিজের বাড়ির হতে পারে বা ভাড়া করা কিচেন হতে পারে৷
কিচেন যেরকমই হোক সেটা যেন টার্গেটেড এরিয়া এবং কাস্টমারের কাছাকাছি হয়৷ এমন একটা স্থান নির্বাচন করুন যেখান থেকে কম সময়ে গরম গরম খাবার পৌঁছানো সহজ হয়। আর হ্যাঁ পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটাও মাথায় রাখবেন। খেয়াল রাখবেন কিচেনের আশেপাশে যেন কোন নর্দমা, ডোবা, বা ডাস্টবিন না থাকে। কিচেনের ভিতরের পরিচ্ছন্নতাও সমানভাবে জরুরী।
৩. ডকুমেন্টেশনঃ
শুধু রান্না করে ডেলিভারি দিলাম আর ব্যবসা চলতে লাগলো – ব্যাপারটা কিন্তু এরকম না। যেহেতু ক্লাউড কিচেন হচ্ছে ভার্চুয়াল রেস্টুরেন্ট সেহেতু এর লাইসেন্স করতেই হবে। এই ধরণের ব্যবসার জন্য সাধারণত যেসব লাইসেন্স লাগে তা হল-
- ট্রেড লাইসেন্স
- স্যানিটারি লাইসেন্স
- ফায়ার লাইসেন্স
- প্রিমিসেস লাইসেন্স
- পরিবেশ ছাড়পত্র
- কৃষি উপকরণ সনদ
- ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু লাইসেন্স কম-বেশী লাগতে পারে। কিছু এজেন্সি থাকে যারা নিজ দায়িত্বে এসব লাইসেন্স করিয়ে দেয়। আপনার দেশে বা নিকটবর্তী জায়গায় এমন এজেন্সি আছে কিনা খোঁজ করুন। এজেন্সি পরিবর্তে দালাল দিয়েও কাজ হয় কম সময়ে কিন্তু খরচ একটু বেশি পড়তে পারে। চাইলে দালালের খোঁজ করুন।
৪. লোকবল নিয়োগঃ
রাঁধুনী ভালো না হলে কিন্তু ক্লাউড কিচেন ব্যবসা টিকবে না। তার সাথে সার্বক্ষণিক সার্ভিস দেয়ার মতো লোকও থাকা চাই। কমপক্ষে দুইজন রাঁধুনী, দুইজন অ্যাসিস্টেন্ট, দুইজন ক্লিনার রাখতেই হবে কিচেন পরিচালনার জন্য। আপনি যদি রান্না করেন তাহলে অতিরিক্ত একজন বা দুইজন রাঁধুনী নিয়োগ দিবেন।
সার্বক্ষণিক ফোনকল ও অর্ডার নেয়ার জন্য একজন লোক রাখতে হবে। যদি নিজে করতে পারেন তাহলে ভালো। আর ক্যাশের ব্যাপারটা নিজে হ্যান্ডেল করাটাই নিরাপদ। কর্মী হায়ার করলে তাদের ট্রেইনিংয়ের দায়িত্ব কিন্তু আপনার। অদক্ষ জনবলের কারণে ব্যবসা লাটে উঠতে বেশী দেরি হবে না।
যাদের হায়ার করবেন তাদের জন্য ফুড প্যাকেজিং ও হাইজিনের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। হাইজিন নিশ্চিত করতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক, গ্লাভস, হেড ক্যাপের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
৫. অর্ডার ব্যবস্থাঃ
মানুষ অনলাইনে আপনার থেকে খাবার অর্ডার করবে, আর আপনি ডেলিভারি ম্যানের মাধ্যমে তাদেরকে খাবার পৌঁছে দিবেন। এই কাজটা সুষ্ঠুভাবে করার জন্য আপনাকে নিতে হবে একটি থার্ড পার্টি ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সাহায্য। অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অর্ডার ব্যবস্থা ও পেমেন্ট করা খুব সহজ হয়ে যাবে।
জোম্যাটো, ফুড পান্ডা, উবার ইটস, বা অন্য যেকোন ভালো মানের ডেলিভারি অ্যাপের সাথে যোগাযোগ করে নিবেন। এই অ্যাপগুলো অর্ডার প্রতি কিছু কমিশন নেয় বা চুক্তির সময় এককালীন একটা অ্যামাউন্ট নেয়। আর অবশ্যই অ্যাপের সাথে সাথে ভালো এবং বিশ্বস্ত পেমেন্ট সিস্টেম থাকতে হবে।
যদি আপনার নিজস্ব অ্যাপ/ওয়েবসাইট ও ডেলিভারি ম্যান থাকে তাহলে খুবই ভালো। কিন্তু নতুন অবস্থায় এটা করতে গেলে ঝামেলা ও খরচ দুটোই বাড়বে। তাই নিজস্ব ডেলিভারির চিন্তা থাকলে ব্যবসা বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৬. প্রয়োজনীয় সরঞ্জামঃ
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সম্পর্কে আইডিয়া না থাকলে খাবার রান্না করতে ও পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হবে। খুব চিন্তাভাবনা করে কিচেনের জন্য আইটেম কিনবেন। অভিজ্ঞ কারো পরামর্শ নিতে পারলে ভালো হয়।
যেহেতু নতুন অবস্থায় বাজেট সেরকম থাকবে না সেহেতু দরকারী জিনিসগুলোতে একটু বেশী ইনভেস্ট করবেন। স্টোভ, ফ্রিজ, এবং চিমনী – এই তিনটা জিনিস বেশী প্রয়োজনীয়। তাই এগুলোতে বাজেট একটু বেশী রাখবেন।
এবার আসি প্যাকেজিং আইটেমের ব্যাপারে। খাবার এমনভাবে প্যাকেজিং করবেন যাতে তা অনেকক্ষণ গরম থাকে আর নষ্টও না হয়। তার জন্য ফয়েল প্যাক, প্লাস্টিকের বক্স, বা শক্ত কাগজের বক্স লাগবে।
সবসময় সব গ্রাহকের কাছে প্লেট-চামচ না-ও থাকতে পারে। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে ডিসপোজেবল গ্লাস, প্লেট, চামচ দিতে পারেন খাবারের সাথে।
কাঁচামাল পাইকারীর একটি ভালো দোকান থেকে নিয়মিত কেনার চেষ্টা করুন। এতে ভালো মানের জিনিস পাবেন, সাশ্রয় হবে, আর ডেলিভারিও দ্রুত পাবেন। আর যদি প্যাকেজিংয়ে নতুনত্ব আনতে পারেন তাহলে গ্রাহককে আকৃষ্ট করা কঠিন হবে না।
৭. অর্ডার হ্যান্ডেলঃ
অ্যাপ থেকে যখন ক্রমাগত অর্ডার আসতে থাকবে তখন ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাতে সময়মতো খাবার ডেলিভারি হয় সেদিকে নজর দিবেন। প্রতিদিন কতোটা অর্ডার আসছে তার জন্য খাতায় হিসাব রাখবেন।
একজনের অর্ডার ভুলে আরেকজনের কাছে গেলে, বা অর্ডার করা খাবারে কিছু বাদ গেলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষতিপূরণ দিবেন। গ্রাহক খাবারে কোন ত্রুটি খুঁজে পেলে সেটা সাজেশন হিসেবে নিবেন। এসব ব্যাপার ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
সুষ্ঠুভাবে অর্ডার হ্যান্ডেল করতে পারলে গ্রাহক বেড়ে যাবে। কিছু সফটওয়্যার আছে যেগুলো নির্বিঘ্নে হাজার হাজার অর্ডার হ্যান্ডেল করতে সাহায্য করে। কিন্তু এগুলো ব্যয়বহুল হতে পারে। তাই নতুন অবস্থায় সফটওয়্যারের উপর নির্ভরশীল না হলেই ভালো হয়।
৮. মার্কেটিংঃ
প্রচার না থাকলে আপনার কিচেন থেকে কেউ খাবার অর্ডার করবে না। অফলাইন কিচেনে খাবারের পরিচিতি মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু অনলাইন কিচেনে ভার্চুয়াল মার্কেটিংই সব।
আপনি একাধিক ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সাথে যুক্ত থাকবেন। নিজস্ব ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যানেল, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট রাখবেন। সেই অ্যাকাউন্টগুলোতে খাবারের ছবি চমকপ্রদ ক্যাপশনের সাথে শেয়ার করবেন।
নিজের লোকেশন সোশ্যাল মিডিয়ায়, গুগল ম্যাপে শেয়ার করবেন। গ্রাহককে উৎসাহ দিবেন ফুড রিভিউ দেয়ার জন্য। বিশেষ দিনে বা উপলক্ষে ডিসকাউন্ট বা অফারের ব্যবস্থা করবেন। এভাবে অনলাইনে আপনার উপস্থিতি যত বেশি দেখাবেন তত তাড়াতাড়ি গ্রাহক আপনাকে খুঁজে পাবে, অর্ডার করবে।
ক্লাউড কিচেন ব্যবসায় পুঁজি কত লাগবে?
এই বিজনেসের প্রধান সুবিধা হল, অন্যান্য বিজনেসের তুলনায় পুঁজি বেশ কম লাগে। নিজে রান্না জানলে ব্যবসার পথ অনেকটাই মসৃণ হয়ে যায়। আর গতানুগতিক রেস্টুরেন্টের মতো ডেকোরেশন ও মেইনটেইনেন্সে খরচ হয় না বললেই চলে। স্টাফও লাগে কম। তাই সময় ও খরচ বেঁচে যায় অনেকটা। মোটামুটি ৬ মাসের মোট ব্যয় হাতে নিয়ে ক্লাউড কিচেন চালু করা উচিত। টাকার অঙ্কে ৪-৫ লাখের মতো লাগতে পারে। কিন্তু যদি কিচেন ভাড়া, লাইসেন্স খরচ, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কম হয় তাহলে আরো কমে ব্যবসা চালু করতে পারবেন।
Good proposal.
Thank you Sangita 🙂