মুলো এমন একটি সবজি, যার দুর্গন্ধের কারণে অনেকেই এর দুর্নাম করে ঠিকই, কিন্তু সুনাম সেভাবে করে না। হয়তো এর গুণাগুণ সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই তাই এরকম হয়৷ সাদা, লাল, বা হালকা গোলাপী রঙের এই সবজিতে আছে হরেক রকমের পুষ্টি উপাদান। মুলো কাঁচা খাওয়া হোক বা রান্না, সব অবস্থাতেই এটি দেহ নীরোগ রাখতে সাহায্য করে। মুলো খাওয়ার উপকারিতা জেনে নিন আজকের আর্টিকেল থেকে। আর আসছে শীতে ডায়েটে মুলো রাখতে ভুলবেন না যেন!
মুলো খাওয়ার উপকারিতাঃ
১. ওজন কমায়ঃ
মুলো একটি ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য। যাদের লক্ষ্য ওজন কমানো তাদের নিয়মিত মুলো খাওয়া উচিত। এটি ক্ষুধা কমায়, ফলে বারবার খাওয়ার তাগিদ থাকে না এবং দেহের ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে। ওজন কমানোর জন্য মুলোর রস করে তার সাথে লেবু ও লবণ মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস সারায়ঃ
মুলোর ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য সারায়। আর কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে থাকলে পাইলসও দূরে থাকে। মুলোয় এমন কিছু উপাদান আছে যা হজমশক্তির উন্নতি ঘটায়। সেই সাথে রেচনক্রিয়াও ত্বরান্বিত করে। ফলে মলত্যাগে কষ্ট অনুভূত হয় না। এছাড়াও পাইলস রোগীদের জন্য মুলোর বা মুলো শাকের তরকারি বেশ উপকারী। মুলোর স্যুপ বা শুকনা মুলোর কাপড়ে পেঁচিয়ে সেঁক দিলে পাইলসের ব্যথা কমে যায়। পেট ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় মুলোর রস ও লেবুর রস একসাথে করে খেলে পেটের সমস্যা দূর হযে যায়।
৩. লিভার ঠিক রাখেঃ
লিভারের বর্জ্য পরিষ্কার করতে মুলোর ভূমিকা অনন্য। জন্ডিসের চিকিৎসাতেও মুলো কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এটি রক্তে বেড়ে যাওয়া বিলিরুবিন নিয়ন্ত্রণ করে, অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়, এবং ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ করে। মুলো লিভারের ইনফেকশনও প্রতিরোধ করে।
৪. কিডনীর কার্যক্ষমতা বাড়ায়ঃ
কিডনীর যাবতীয় সমস্যা দূর করে মুলো। এটি কিডনী থেকে টক্সিক এলিমেন্ট বের করে দেয়। ফলে কিডনী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। মুলো মূত্রবর্ধক হিসেবেও বেশ পরিচিত। নিয়মিত মুলো খেলে প্রসাবের জ্বালাপোড়া দূর হয়, প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায়, এবং ইউনারী ট্র্যাক্টের সমস্যা চলে যায়।
৫. ক্যান্সার দূর করেঃ
ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী রোগকেও দূরে সরাতে সক্ষম মুলো। এতে আছে ভিটামিন সি, ফলিক অ্যাসিড, এবং অ্যান্থোসায়ানিন নামক একটি বিশেষ উপাদান। এই উপাদানগুলো দেহে ক্যান্সার কোষের জন্ম ও বৃদ্ধি আটকায়। অন্ত্রনালী, পাকস্থলী, কোলন, মুখ, এবং কিডনী ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য মুলো তাই খুবই উপকারী।
৬. হৃদযন্ত্র ঠিক রাখেঃ
মুলো হৃদযন্ত্র ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এতে বিদ্যমান অ্যান্থোসায়ানিন ও উচ্চ মাত্রার পটাশিয়াম হার্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আবার মুলোতে আছে ফাইট্রোস্টেরল নামক আরেকটি উপাদান যা হৃদপিন্ড সুস্থ রাখে। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওযার আশঙ্কা কমে যায়।
৭. রক্তচাপ কমায়ঃ
পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। মুলোতে যে পরিমাণ পটাশিয়াম আছে তা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও মুলোর হাইপার-সেনসিটিভ বৈশিষ্ট্যও উচ্চ রক্তচাপ হতে দেয় না। মুলোর আছে রক্ত পরিষ্কার করার ক্ষমতা।
৮. ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করেঃ
মুলো এবং মুলোর পাতা উভয়ই শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। এতে আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, এবং আরো নানা ধরণের পুষ্টি উপাদান। পর্যাপ্ত ভিটামিন দেহে প্রবেশ করলে ভিটামিনের অভাবজনিত রোগবালাই থাকে শতহস্ত দূরে।
৯. দাঁত ও মাড়ির জন্য উপকারীঃ
মুলোর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দাঁত ও মাড়ির জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে মুলোর শাক দাঁতের সমস্যা দূরীকরণে ভালো কাজ করে। মাড়ি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা থেকে মুক্তি দেয় মুলোর শাক।
১০. হাঁপানির চিকিৎসায় মুলোঃ
হাঁপানি রোগীদের নিয়মিত মুলোর রস খাওয়া উচিত। কারণ এটি ফুসফুসে জমে থাকা মিউকাস ভেঙে দেয়। ফলে হাঁপানি আস্তে আস্তে কমে যায়। আবার এর অ্যান্টি-কনজিস্টেটিভ বৈশিষ্ট্য নাক, গলা, শ্বাসনালী, এবং ফুসফুসের জ্বালাবোধ রোধ করে। মুলোর রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে হাঁপানির সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
১১. প্রদাহ কমায়ঃ
মুলো শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। তাই দেহে ইনফেকশন সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। আবার এর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে বিভিন্ন ধরণের ইনফ্লেমেশন ও ব্যথা কমিয়ে দেয়। আবার মুলোর ভিটামিন সি ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং কোলাজেন গঠনে সাহায্য করে। তাই বাতের ব্যথা নিরাময়ের জন্য মুলো খাওয়া যেতে পারে।
১২. কাটাছেঁড়া সারায়ঃ
মুলোর রস কাটাছেঁড়া সারানোর কাজে লাগে। পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে ক্ষত হলে সেই ক্ষতের উপর মুলোর রস লাগালে নিরাময় হয়। আবার শ্বেতী রোগের চিকিৎসাতেও মুলোয় বিদ্যমান অ্যান্টি-কার্লসেলোজনিক উপাদান বেশ কাজে দেয়। মুলোর বীজ থেঁতো করে এর সাথে আদার রস ও ভিনেগার মিশিয়ে শ্বেতরোগাক্রান্ত জায়গায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
১৩. সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেঃ
ত্বক ও চুল স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করার জন্য মুলোর কোন জুড়ি নেই। নিয়মিত মুলোর রস খেলে দেহে ভিটামিন সি, জিঙ্ক, এবং ফসফরাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ত্বক থাকে নীরোগ ও সুন্দর। কাঁচা মুলোর পাতলা স্লাইস বা এর পেস্ট ফেসপ্যাক ও ক্লিনজার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মুলোর রস ও জলপাইয়ের রস একসাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে শুষ্ক ও ফাটা ত্বক মোলায়েম হয়। আবার মুলা খুশকি দূর করে, চুলের গোড়া শক্ত করে, এবং স্ক্যাল্পের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। মুলোর ক্যারোটিনয়েড দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
১৪. জ্বর সারায় ও রুচি বাড়ায়ঃ
জ্বর কমাতে সাহায্য করে মুলো। সেই সাথে জ্বরের কারণে খাওয়ার রুচি চলে গেলে তা ফিরিয়ে আনে কাঁচা মুলো। কাঁচা মুলো গ্রেট করে বা কুচি কুচি করে কেটে লবণ মিশিয়ে খেলে মুখের রুচি ফিরে আসে।
১৫. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ
পুষ্টিগুণে ভরপুর মুলো দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷ এতে বিদ্যমান ফসফরাস ও আয়রনের কারণে ইমিউনিটি শক্তিশালী হয়। আবার মুলোর ভিটামিন সি দেহের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, কোলাজেন গঠন করে, এবং বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করে। মায়েদের বুকের দুধ বাড়াতেও মুলার ভূমিকা অপরিসীম।
সতর্কতাঃ
- যেহেতু মুলো প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, সেহেতু এটি দেহে পানিশূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে, যদি প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত মুলো খাওয়া হয়। কিডনী রোগীদের ডায়েটে কিডনীর ওষুধ অন্তর্ভুক্ত থাকলে মুলো খাওয়ানো উচিত না।
- একইভাবে বেশী মুলো খেলে শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় এবং জটিলতা সৃষ্টি হয়। ব্লাড প্রেসারের রোগীদের ডায়েটে প্রেসারের ওষুধ থাকাকালীন সময়ে মুলো খাওয়া নিষেধ।
- মুলো রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ঘন ঘন মুলো খেলে শর্করার পরিমাণ কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়৷ তাই ডায়বেটিস থাকলে মুলো অল্প বা মাঝারি পরিমাণে খেতে হবে। আর খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে খাওয়া উচিত।
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার মুলো বেশি খেলে দেহে আয়রনের আধিক্যজনিত সমস্যা, যেমন পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, খিঁচুনি, লো সুগার, ইন্টার্নাল ব্লিডিং ইত্যাদি হয়।
- মুলোয় গাইট্রোজেন নামক এক ধরণের যৌগ আছে। এই যৌগ থাইরয়েড গ্রন্থির জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। তাই থাইরয়েড রোগীদের মুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।