আচ্ছা, আপনার রান্নাঘরে তো নিশ্চয়ই আদা আছে, তাই না? তরকারিতে দেয়া ছাড়া হালকা ঠান্ডা, গলা ব্যথায় মা-ঠাকুমা নিশ্চয়ই আদা দিয়ে টোটকা করে আপনাকে খাওয়ান। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, আদার উপকারিতা শুধু ঠান্ডা নিরাময়ে সীমাবদ্ধ না। বিভিন্ন ধরণের খনিজ পদার্থ, ভিটামিন, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদানে সমৃদ্ধ এই মসলা পেটের সমস্যা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার সহ নানা ছোট বড় রোগ সারায় কিংবা প্রতিরোধ করে। আজকের আর্টিকেলে কথা বলবো আদার উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত। তো দেরি না করে চলুন শুরু করা যাক মূল আলোচনা৷
ক. আদার উপকারিতাঃ
১. পেটের সমস্যা ঠিক করেঃ
পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, আলসার, গ্যাস্ট্রিক, বদহজম, আমাশয় ইত্যাদি নানাবিধ পেটের সমস্যা দূর করে আদা। আদার বেদননাশক উপাদান পেট ব্যথায় তাৎক্ষণিক আরাম দেয়। তাই পেট ব্যথা করলে আদা চা খেতে পারেন৷
খাবার সহজে হজম না হলে বা ভারী খাবার খাওয়ার পরে পেটে অস্বস্তি হয়। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে খাওয়ার পরে এক টুকরো আদা চিবিয়ে খাবেন। এতে পেটের অম্লভাব কেটে যাবে, বদহজম হবে না। পাশাপাশি, আদার রস খাবারের পুষ্টি সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে দিবে।
পেট খারাপ বা গ্যাস্ট্রিক হলেও আদা খেতে পারেন। এটি আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট শিথিল করে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করবে। হুটহাট আমাশয় বা পেট ফাঁপা হলে এক কাপ গরম জলে এক চা চামচ আদার রস মিশিয়ে খেলে উপকার পাবেন।
কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবত কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেট ফাঁপার সমস্যা হলে নিয়ম করে আদার জল খেতে হবে। এক কাপ গরম জলে এক চা চামচ আদার রস মিশিয়ে প্রতিদিন ছয়-সাতবার খাবেন, এভাবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর থেকে দুই বেলা এক কাপ গরম জলে আদার রস, লেবুর রস, এবং মধু এক চা চামচ করে মিশিয়ে খাবেন যতদিন না গ্যাসের সমস্যা চলে যাচ্ছে।
২. হাড়ের ব্যথা কমায়ঃ
সত্যিকার অর্থে অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কোন স্থায়ী চিকিৎসা বা সমাধান নেই। কারণ হাড় একবার ক্ষয় হতে শুরু করলে সেটা কোনদিন বন্ধ হয় না। কিন্তু ওষুধ-পথ্যের মাধ্যমে হাড় দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি কিছুটা কমানো যায়। আর এই ক্ষেত্রে আদা দারুণ কাজ করে।
এক কাপ গরম জলে ১ চা চামচ করে লেবুর রস, আদার রস, ও মধু মিশিয়ে খেতে হবে। প্রতিদিন দুই বেলা চায়ের মতো করে খেলে হাড়ের ব্যথার তীব্রতা কমবে। আদায় বিদ্যমান ক্যালসিয়াম হাড়কে মজবুত করতে সাহায্য করে।
আপনার যদি বাতের ব্যথা বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস থাকে তাহলে নিয়মিত কাঁচা আদা খেতে পারেন। ব্যথা কমে যাবে অনেকটাই। কাঁচা খেতে না চাইলে আদার চা খান, উপকার পাবেন। আদা জলে সেদ্ধ করে সেই জল দিয়ে স্নান করতে পারেন। আবার হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হলে আদার তেলও মালিশ করতে পারেন।
৩. ঠান্ডা ও কাশি কমায়ঃ
আদাকে বলা হয় ন্যাচারাল পেইন রিলিভার৷ গলা ব্যথা উপশমে কাঁচা আদা ভালো কাজ করে। সাধারণ ঠান্ডা, কাশি, এবং ফ্লু এর ওষুধ হিসেবে আদার রসের ব্যবহার করতে পারেন। সমপরিমাণ আদার রস ও মধু মিশিয়ে ১০ সেকেন্ড গরম করে খাবেন, ঠান্ডা কমে যাবে। আবার গরম জলে লেবু, আদা, ও মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। কাশি কমবে, কফ থাকলে তা-ও দূর হবে।
আদা ঠান্ডার সমস্যা কমানোর পাশাপাশি ফুসফুসকেও সুস্থ ও পরিষ্কার রাখে। শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য আদা-লেবু-মধুর এই টনিকটি দুই বেলা করে টানা ১৫ দিন খাবেন। তার সাথে সাথে ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চলবেন।
৪. মস্তিষ্কের রোগ কমায়ঃ
আদা নানাভাবে মস্তিষ্কের রোগ সারায়। এক কাপ আদা চা স্নায়ুকে প্রশান্তি দেয়, তাই সমস্ত ধরণের স্ট্রেস থাকে দূরে। স্ট্রেস থেকে ঘটিত নানা ছোট বড় রোগ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না। আদা সেদ্ধ করে সেই জল দিয়ে স্নান করলে শরীর ঝরঝরে লাগবে, মাথা ঠান্ডা থাকবে।
অনেকে বৃদ্ধ বয়সে আলঝেইমার্স নামক রোগে ভোগেন। কেউ কেউ মধ্য বয়সেও এই রোগে ভোগেন। আলঝেইমার্স হওয়ার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস। আদাতে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ও বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ এই জটিল রোগ দূরে রাখতে সক্ষম। নিয়মিত আদা খেলে মস্তিষ্কে প্রদাহের কারণে হওয়া স্মৃতি হ্রাস প্রতিরোধ করা যায়। পাশাপাশি, আদা মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করে।
৫. মাইগ্রেন ও সাইনাসের ব্যথা কমায়ঃ
আদায় বিদ্যমান ভিটামিনস মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে, তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথায় আদার চা খেলে উপকার পাওয়া যায়। যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে তাদের উচিত আদা দিয়ে লিকার চা করে খাওয়া। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হিসেবে কাঁচা আদায় সামান্য নুন মাখিয়ে খাওয়া যেতে পারে৷ আদার রসও কিন্তু মাইগ্রেন ও সাইনাসের ব্যথা কমাতে পারে। ব্যথার জায়গায় আদা পেস্ট করে লাগালে রক্তনালীর প্রদাহ কমবে ও ধীরে ধীরে ব্যথা কমে যাবে।
৬. হৃদরোগ কমায়ঃ
আদা, মধু, ও লেবুর টনিক প্রতিদিন দুই বেলা করে খেলে হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকবে ও হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে৷ তবে রোগীর ডায়বেটিস থাকলে মধু বাদ দিতে হবে। আদাতে যে পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে তা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। আবার এর ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যামিনো অ্যাসিড রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় ও ধমনীতে চর্বি জমতে দেয় না। এতে করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ঠিক থাকে ও উচ্চ রক্তচাপ দূরে থাকে।
৭. বমি ভাব সারায়ঃ
যাদের গাড়িতে চড়লে বা অন্য কোন কারণে বমি বমি ভাব হয়, তারা আদা খেলে উপকার পাবেন। গর্ভবতী মহিলাদের মর্নিং সিকনেস কাটাতেও আদা কাজ করবে। আবার অপারেশন বা কেমোথেরাপির পরবর্তী বমি বমি ভাবও আদা সারিয়ে তুলবে। সামান্য পরিমাণে আদার রস বা এক টুকরো কাঁচা আদা নুন মাখিয়ে খেলে বমি ভাব কেটে যাবে। বমির সাথে জ্বর জ্বর ভাব হলে গরম জলে এক চা চামচ আদার রস মিশিয়ে ছয়-সাত বার খেতে হবে। দূরের যাত্রাপথে বমি ভাব হলে আদার সাথে পুদিনা পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আদা-মধু দিয়ে চা খেলেও উপকার পাবেন।
৮. ঋতুস্রাবের ব্যথা কমায়ঃ
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর আদা ঋতুস্রাব বা মাসিকের তীব্র ব্যথা উপশমে কার্যকর। মাসিকের সময় আদা চা অনেক মেয়েরাই খেয়ে থাকেন। চায়ের পরিবর্তে আদার জলও খাওয়া যেতে পারে। এক কাপ গরম জলে কয়েক টুকরো আদা ফুটিয়ে তাতে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এছাড়াও আদা দেয়া লিকার চায়ে চিনির পরিবর্তে একটু মধু মিশিয়ে খেলে পিরিয়ড সাইকেল ঠিক থাকবে। আদা সেদ্ধ করা জলে তোয়ালে ভিজিয়ে তলপেটে সেঁক দিলে ব্যথা কমে যাবে।
৯. লিভার সুস্থ রাখেঃ
লিভার সুস্থ রাখতে আদার জুড়ি নেই। এর জন্য আদার গুঁড়ো, আমলকির গুঁড়ো, এবং মধু সমপরিমাণে নিয়ে গরম জলে মিশিয়ে চায়ের মতো করে খেতে হবে। প্রতিদিন তিন বার করে এই চা খেলে লিভারের শক্তি বেড়ে যাবে। এছাড়াও আদা-মধু-লেবুর টনিকও খাওয়া যেতে পারে লিভার ও পাকস্থলী সুস্থ রাখার জন্য।
১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ
আদা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষ ধ্বংস করে। যার কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। আদার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রোপার্টিজ দেহে ক্যান্সারের বংশ বিস্তার হওয়াকে আটকায়। আবার এর জিনজেরল নামক উপাদানও ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। আদা মূলত ব্রেস্ট ক্যান্সার, ওভারি ক্যান্সার, এবং গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য বেশী উপকারী।
১১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
আদার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রোপার্টিজ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে শরীরে ইনফেকশন সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। আবার এর অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান ক্ষতস্থান দ্রুত শুকিয়ে ফেলে। শরীরের কোথাও ক্ষত হলে বেশী করে আদা খাবেন, ক্ষত শুকিয়ে যাবে। চাইলে ক্ষতস্থানে এক টুকরো আদাও ঘষে দিতে পারেন। এছাড়াও আদা দাঁত ও মুখের ভেতরে থাকা জীবাণু ধ্বংস করে, কান ব্যথা, চুল পড়া, ত্বকের কুঁচকে যাওয়া ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা সারিয়ে তোলে। এমনকি রেচনতন্ত্রে সমস্যা সমাধানেও আদা ওষুধের মতো কাজ করে।
১২. ওজন কমায়ঃ
আদার শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি খেলে পেট অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভরা মনে হয়। ফলে খাওয়ার তাগিদ থাকে না ও শরীরে ক্যালোরি কম প্রবেশ করে। পাশাপাশি, আদা স্থূলকায় মানুষের অতিরিক্ত বিএমআই কমিয়ে স্বাভাবিক রেঞ্জের (১৮.৫ – ২৫) মধ্যে নিয়ে আসে৷
খ. আদার কিছু অপকারিতা আছে যা আপনার জানা উচিতঃ
- অতিরিক্ত আদা খেলে ডায়রিয়া, পেট ফোলা, বদহজম, লো ব্লাড প্রেসার, লো সুগার লেভেল হতে পারে। দৈনিক ৫ কাপের বেশী আদা চা খেলে মাইগ্রেন ও অনিদ্রার সমস্যা বেড়ে যাবে।
- আদা খেলে শরীরে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। গর্ভাবস্থায় আদা খেলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
- যারা আগে থেকেই এলার্জিতে ভোগেন তাদের আদা যতোটা সম্ভব কম খেতে হবে। কারণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশী আদা খেলে শরীরে চুলকানি ও ফুলে যাওয়া দেখা দিতে পারে৷
গ. আদা খাওয়ার নিয়মঃ
রান্নায় আদা খেলে যতোটা উপকার পাবেন, কাঁচা, সেদ্ধ, বা রস করে খেলে তার দ্বিগুণ উপকার পাবেন। কাঁচা আদা শুধুও খেতে পারেন আবার সামান্য নুন মাখিয়েও খেতে পারেন। ছেঁচে বা পিষে খেতে পারলে আরো ভালো হয়। আদা চা-ও সমান উপকারী। যদি রস করে খেতে চান তাহলে দৈনিক ১৫ গ্রামের বেশী রস খাবেন না। আর আদা সবসময় তাজা অবস্থায় খাওয়া উচিত। দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিজে পড়ে থাকা আদা থেকে কোন উপকার পাওয়া যাবে না।
,ভাল লাগল
ধন্যবাদ। 🙂