একটুতে বদহজম বা পেঁট ফাঁপলে আমরা কত ধরণের ওষুধ খাই। কেউ কেউ তো আবার কার্বোনেটেড কোল্ড ড্রিংকস খান পেটের সমস্যা থেকে সাময়িক আরাম পাওয়ার জন্য। এগুলো স্থায়ী কোন সমাধান না। বরং এগুলো সমস্যা আরো বাড়িতে তোলে। দৈনন্দিন জীবনে একটু সচেতন হলে পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখা সম্পূর্ণ সম্ভব। আপনার যদি খাবার হজমে সমস্যা হয় তাহলে এই সহজ উপায়গুলি অবলম্বন করে সমস্যা থেকে মুক্তি পান অচিরেই। উপায়গুলোর বিস্তারিত পাবেন এই আর্টিকেল থেকে।
১. মনোযোগ দিয়ে খানঃ
সবচাইতে সহজ যে উপায়ের মাধ্যমে আপনি খাবার হজম করতে পারেন সেটা হল, মনোযোগের সাথে খাবার খাওয়া। ইংরেজিতে এটাকে এক কথায় ‘মাইন্ডফুল ইটিং’ বলে। খাওয়ার সময়ে টিভি বা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আপনি নিজের অজান্তেই বড় বড় বাইট মুখে ঢুকিয়ে ফেলবেন। আবার সেগুলো ঠিকমতো চিবানোর জন্যও মনোযোগ থাকবে না আপনার।
এতে গলায় খাবার আটকে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে। আবার খাবারের বড় টুকরা পেটে গেলে হজম হতে বেশ সময় নেবে। ফলে গ্যাস, অম্বল, বদহজম হবে। কাজেই খাওয়ার সময় টিভির সামনে বা মোবাইল হাতে নিয়ে না বসে খাবারের দিকে পুরো অ্যাটেনশন দিন এবং ভালো করে চিবিয়ে খান। যত ভালো করে খাবার চিবিয়ে খাবেন তত বেশি পাচকরস নিঃসৃত হবে এবং খাবার দ্রুত হজম হবে।
২. সঠিক ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করুনঃ
সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বিগড়ে যাওয়া হজমশক্তি খুব তাড়াতাড়ি ঠিক করা যায়। ৬টি মৌলিক খাদ্য উপাদান আছে এমন খাবার পাকস্থলীর শক্তি বৃদ্ধি করে, হজমক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। সেই সাথে দেহের অভ্যন্তরীণ জৈবিক প্রক্রিয়া সচল রাখে। তাই চেষ্টা করবেন প্রতিদিনের ডায়েটে সুষম খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করার।
প্রচুর পরিমাণে আঁশযুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল শরীরকে জল শোষণে সাহায্য করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কাঁচার চেয়ে রান্না করে খাওয়া ভালো। যেমন গাজর কাঁচা খাওয়ার চেয়ে রান্না বা সেদ্ধ করে খেলে ভালো ফল পাবেন।
পরিমিত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটও হজমশক্তি বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত উপকারী। বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিড, যেমন আলসারেটিভ, কোলাইটিস খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে সাহায্য করে এবং পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, যেমন বাদাম, চিয়া বীজ, মাছ নিয়মিত খাবেন।
৩. পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুনঃ
শরীর ঠিক রাখতে জলের কোন বিকল্প নেই। জলের অভাবে ডিহাইড্রেশন তো হয়ই, সেই সাথে হজমেরও ব্যাঘাত ঘটে। জলের ঘাটতি শরীরের অভ্যন্তরীণ শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে বাধা প্রদান করে, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ইউরিন ইনফেকশন ঘটায়, এমনকি কিডনি বিকল পর্যন্ত করতে পারে।
তাই এসব থেকে বাঁচতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও জলীয় খাবার খাবেন। রসালো ফলমূল ও শাকসবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের রস খাবেন। সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন আপনাকে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লিটার জল খেতেই হবে।
৪. সঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করুনঃ
প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে খাওয়াদাওয়া করবেন। অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া পেটে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। কখনোই ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাবেন না। পেট খালি থাকলে প্রয়োজনমতো খাবেন, পেট ভরলে খাওয়া বন্ধ করবেন। ক্ষুধা নিয়ে বেশিক্ষণ থাকলে এবং অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে হজমশক্তি কমে যায়, গ্যাস, বদহজম, এবং পেট ফাঁপা হয়৷
তিন বেলা খাওয়ার মধ্যে কমপক্ষে ৬ ঘন্টা বিরতি রাখবেন। প্রতিদিন এক সময়ে খাবেন, একদিন এক সময়ে আরেকদিন আরেক সময়ে খাবেন না। রাতের খাবার কখনোই বেশি দেরিতে খাবেন না।
দেরিতে খেলে খাওয়ার সাথে সাথে ঘুমাতে হবে। তাতে পাকস্থলী খাবার হজম করার সময় পাবে না। আবার ঘুমের মধ্যে শরীরবৃত্তীয় কাজ কম হয় বলে তখনও হজম হবে না ঠিকমতো। তাই রাতের খাবার ঘুমের কমপক্ষে এক ঘন্টা আগে সেরে নিবেন।
৫. শরীরচর্চা করুন প্রতিদিনঃ
- প্রতিদিন ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করলে হজমক্রিয়া ও অন্যান্য শরীরবৃত্তীয় কাজ সচল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সকলেরই প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, জগিং করা উচিত।
- প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হাঁটলে আপনার অন্ত্রের অ্যাক্টিভিটি সাধারণের চাইতে ৩০% বেড়ে যাবে। মেটাবলিজম ভালো করার জন্য শরীরের মাঝের অংশ থেকে নিচ পর্যন্ত অংশের ব্যায়াম করা বেশি জরুরি। এর জন্য বিশেষ কিছু ব্যায়াম করতে হবে। যেমন রিভলভিং চেয়ারে বসে শরীরকে টুইস্ট করবেন। অর্থাৎ দেহের উপরের অংশ এক দিকে এবং নিচের অংশ আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিবেন।
- আরেকটি ব্যায়াম যেটা করতে পারেন সেটা হলো, মেঝেতে শুয়ে পা দুটো ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে উঁচু করে রাখবেন। তারপর পা গুলো বাম থেকে ডানে ডান থেকে বামে কয়েকবার ঘোরাবেন। পা ঘোরাতে না চাইলে সমস্যা নেই। দেয়ালে পা দুটো ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে উঁচু করে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রাখতে পারেন। এতেও কাজ হবে।
- শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণের উপরেও কিন্তু হজমশক্তি অনেকটা নির্ভর করে। তাই ফুসফুসের ব্যায়ামটাও নিয়মিত করবেন। নাক দিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে লম্বা করে শ্বাস ছাড়বেন। এটা শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াবে এবং হজমশক্তি বাড়াবে।
৬. বাজে অভ্যাস ত্যাগ করুনঃ
ধূমপান, মদ্যপান, ভাজাভুজি, ক্যানড ফুড – এগুলো খাবার সহজে হজম হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে। ধূমপান ও মদ্যপান বদহজম, অ্যাসিডিটি, স্টোমাক আলসার, আলসারেটিভ কোলাইটিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সারের মতো রোগের সৃষ্টি করে৷
আপনার যদি এই বদঅভ্যাস গুলো থাকে এবং আপনি যদি হজমের সমস্যায় ভুগতে থাকেন, তাহলে ধূমপান ও অ্যালকোহল ছেড়ে দিন। দেখবেন আস্তে আস্তে পেটের সব সমস্যা ঠিক হয়ে গেছে। সেই সাথে যদি তেলে ভাজা খাবার, ফাস্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাস থাকে সেটাও কমিয়ে ফেলুন।
ক্যানড ফুডে যেসব প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলো হজমের সমস্যা তো তৈরি করেই, সাথে পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই যত কষ্টই হোক না কেন, বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার চেষ্টা করুন। এবং রেডিমেড, প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলুন।
৭. হজমে সহায়ক খাবার খানঃ
- এমন অনেক খাবার আছে যা হজম প্রক্রিয়াকে সচল করে। সাথে দীর্ঘদিনের হজমের সমস্যাও দূর করে। এখানে একটি তালিকা দেয়া হল। জেনে নিন হজমে সহায়ক কোন কোন খাবার খাবেন।
- আপেল সেদ্ধ করে এর রস নিয়মিত খালি পেটে খেলে বদহজম দূর হয় এবং হজম ক্ষমতা বাড়ে।
- খালি পেটে কুসুম গরম জল পেট ফাঁপা দূর করবে। পেঁপের পাতা সেদ্ধ করে এর জল খেতে পারেন হজমের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।
- জিরার গুঁড়া জলে মিশিয়ে গরম করে খান, হজমের সমস্যা ও পেটের চর্বি দুই-ই দূর হবে। এলাচ নিয়মিত চিবিয়ে খেলে এর ঝাঁজ পেটের অশান্তি দূর করবে।
- দইয়ের স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। আবার এর ল্যাক্টোজ দেহে শর্করার দ্রুত শোষণে সাহায্য করে। ভারী খাবার খাওয়ার পরে বা বদহজম হলে দই খাবেন। এছাড়াও দিনের যেকোন সময় ১৫০-২০০ মিলি টক দই বা মিষ্টি দই খেতে পারেন।
- অতিরিক্ত প্রসেস করার ফলে সাদা ময়দায় আঁশের উপস্থিতি অনেক কম থাকে। ফলে তা লাল ময়দার চেয়ে সহজপাচ্য। লাল ময়দার পরিবর্তে সাদা ময়দার খাবার খেতে পারেন।
- মিষ্টি আলুর আঁশ দ্রুত গলে যায়। এর পটাশিয়াম, প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট দেহে ভালো ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে হজমে সার্বিকভাবে সহায়তা করে।
- সবজি ও মুরগি একসাথে স্যুপ করে খেলে এদের যৌগ সহজে ভেঙে যায় এবং হজম হয়।
- চর্বিহীন মাংসে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট কম থাকার কারণে তা দ্রুত হজম হয়। মুরগি ও মাছে চর্বির ঝামেলা থাকে না তাই এগুলো খেতে পারেন খাসীর মাংসের বদলে।
- ডিম সেদ্ধ করতে যেমন ঝামেলা কম তেমনি এটা হজম শক্তি ভালো রাখে। সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশ ও কুসুম উভয়েই সহজপাচ্য।
- সপ্তাহে অন্তত তিন দিন একটা করে পাকা কলা খাবেন, এটা উচ্চ কার্বোহাইড্রেট সম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত হজম হয়।
৮. স্ট্রেস-ফি থাকুনঃ
স্ট্রেসের কারণে প্রথম প্রভাবটা পড়ে পাকস্থলীর উপর, তারপরে একে একে অন্যান্য সব অর্গ্যানের উপর। দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের কারণে খাওয়া, ঘুম সবেতেই অনিয়ম দেখা দেয়। আর তাতে হজমশক্তি কমে যায়। তাই যতটা সম্ভব নিজেকে মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখুন।
৯. রাতে ঠিকমতো ঘুমানঃ
যারা রাত জেগে কাজ করেন তারা যারা রাতে সময়মতো ঘুমিয়ে পড়েন তাদের চাইতে হজমের সমস্যায় বেশি ভোগেন। রাতের ঘুম শরীরে সারাদিনের ধকল কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই বিশ্রামটা না পেলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যার প্রভাবে পড়ে হজমে।
আবার দিনের তুলনায় রাতের পরিবেশে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। সারারাত জেগে থাকলে শরীরের ইন্টার্নাল সবগুলো অর্গ্যান কাজ করে এবং তাদের অনেক অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আর তা পূরণ না হলে হজম প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ কারণে হেলথ এক্সপার্টরা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই রাত না জেগে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন আর ভোর সকালে উঠে পড়ুন।
১০. এছাড়াও আর কি কি খাবেনঃ
- প্রতিদিন পুদিনার চা খাবেন বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা, বুক জ্বলা, এবং বদহজম থেকে মুক্তি পেতে।
- দৈনিক এক টুকরা কাঁচা হলুদ আপনার পিত্ত পরিষ্কার করবে, হজম শক্তি বাড়াবে, লিভার সুস্থ রাখবে, এবং অন্ত্রনালির প্রদাহ কমাবে।
- খাওয়ার পরে ১ চা চামচ মৌরির বীজ শুধু চিবিয়ে খেতে পারেন বা মৌরির চা বানিয়ে খেতে পারেন। প্রতিদিন দুই বার এক গ্লাস পানিতে আধা টেবিল চামচ মৌরির গুঁড়া মিশিয়ে খাবেন।
- অ্যালোভেরার ব্যাকটেরিয়া ও প্রদাহনাশক বৈশিষ্ট্য পরিপাকনালীর প্রদাহ সারায়। ব্লেন্ডারে ১ গ্লাস কমলার রস বা পানির সাথে ২ টেবিল চামচ অ্যালোভেরার জেল ব্লেন্ড করে নিন। এটা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খাবেন।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ গ্রিন টি হজমশক্তি বাড়ায় ও পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখে। গ্রিন টি পরিবর্তে আদা চা থেকেও এই সুবিধা পাওয়া যাবে।
- বেশি করে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। এটা হজম শক্তি উন্নত করবে।
- হজমের সমস্যা দূর করতে দিনে দুই-তিন বার আদার চা বা আদা-মধু মেশানো গরম জল খেতে পারেন। দেড় কাপ জলে এক চা চামচ আদা কুচি মিশিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন এবং পরে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে খাবেন। অথবা দুই চা চামচ আদার রস ও এক চা চামচ মধু দুই কাপ গরম জলে মিশিয়ে খাবেন। খাওয়ার পরে এক টুকরা কাঁচা আদা চিবিয়ে খেলেও সমান উপকার পাবেন।